কন্যা দান কথাটির অর্থ।
বৈদিক বিবাহ মতে 3টি প্রথা কে ধরা হয়ে থাকে।
যজ্ঞ : আগুনকে পবিত্র মনে করা হয় কারণ এটি সব ধাতুকে পুড়িয়ে শুদ্ধ করে ও আগুনের গতি সবসময় উপরদিকে। অর্থাত প্রথমেই মনে করিয়ে দেয়া হয় যে বিয়েটা এক পবিত্র বন্ধন। বর-বৌ মন্ত্র বলে “যদিদং হৃদয়ং মম…” (অর্থ আমার হৃদয় তোমার হোক …)। বিয়ের ভিত্তি যে হৃদয়ের মিলন, সেটা স্পষ্ট করা হয়। বর-কনে মন্ত্র পড়েপড়ে যজ্ঞের আগুনে ঘি আহুতি দেয় বারবার। কেন? এই যে সম্পর্ক হতে চলেছে একে সঞ্জীবিত করে যেতে হবে জীবনের পথে। নাহলে এটা যান্ত্রিক হয়ে পড়বে।
কন্যাদান : দান কাকে করা হয়? অভাবী মানুষকে।
গরীবকে পয়সা দেয়া, ব্স্ত্রহীনকে কাপড় দেয়া, নিরক্ষরকে শিক্ষা দেয়া। কন্যাদান কেন? পুরুষ অনেক কিছুই শিখেছে, কিন্তু ঘর বাঁধতে শেখেনি।কেন? সে তো বাঁশ-খড় বা ইঁট-সিমেন্ট দিয়ে বাড়ি তৈরি করতে পারে! এখানে মুনি বলেছেন “গৃহিণী গৃহং উচ্যতে”(স্ত্রীই প্রকৃত ঘর)। স্বামী উপার্জন করে কিন্তু সংসার সামলায় স্ত্রী।
বরের এই অভাব মেটাবার জন্য কন্যা আসছে তার শক্তি নিয়ে।শিক্ষা যেমন নিরক্ষরকে শক্তি দেয়
তেমনি স্ত্রী শক্তি দেবে স্বামীকে, এ-কথাই মেয়ের বাবা বলছেন কন্যাদানের মাধ্যমে।
আর এজন্যই স্ত্রীর স্থান স্বামীর বাঁ দিকে। স্বামীর
ডান হাত শক্ত, ঐ হাত দিয়ে সে শিকার করে, অর্থ উপার্জন করে, যুদ্ধ করে। কিন্তু তার বাঁ হাত দুর্বল। স্ত্রী ঐদিককে শক্তি দেবে বলে স্ত্রীর স্থান স্বামীর বাঁ দিকে। এই হলো কন্যা দান র প্রকৃত অর্থ
সপ্তপদী : এতক্ষণ বসেবসে মন্ত্র পড়ার পর এবার একসাথে সাত পা চলা। অর্থাত এখন থেকে যৌথ জীবন, একসাথে পথ চলা। আগুনকে ঘিরে কারণ জীবনে অনেক রকম পরিস্থিতি বহু বাঁধা আসবে, কিন্তু এর মোকাবিলা করতে হবে দুজনে মিলে।
সাত বার কেন? বাইরে 7 ভুবন (ভাল-মন্দ নানান পরিস্থিতি) আর ভেতরে 7 চ্ক্র (মনের নানা অবস্থা)। বাইরে-ভেতরে যাই হোক, স্বামী-স্ত্রীকে তার সমাধান করতে হবে একসঙ্গে — এটাই বলা হচ্ছে । সুখে-দু:খে একসাথে পথ চলার অঙ্গীকার ।
বৌ-ভাত : নববধূ পতিগৃহে এসে রান্না করে খাওয়ায় স্বামীর আত্মিয়-স্বজনকে। এর তাতপর্য —
বধূকে বলা হচ্ছে যে শুধু নিজের সংসারের জন্য কাজ করা নয়, সমাজের কথা ভাবতে হবে। গীতায়
বলা হয়েছে, যারা শুধু নিজের জন্য রান্না করে তারা চোর। সপ্তপদীতে যে যৌথজীবনের শুরু সেটা পরিণত হলো সমাজজীবনে। স্বামী-স্ত্রীকে বলা হলো, কেবল নিজের পরিবারে সীমাবদ্ধ না থেকে সমাজের কথা ভাবতে।
যুগের পরিবর্তনে নানা ভাবে ব্যাবহৃত হতে থাকে এই কন্যা দান শব্দটি।কিন্তু বৈদিক মতে এর মানে খুব ই গুরুত্বপূর্ণ।
এবার যাওয়া যাক মহাভারত র কথাতে।
মহাভারতের কাহিনি থেকে জানা যায়, কৃষ্ণের পরামর্শে অর্জুন, কৃষ্ণেরই আপন বোন সুভদ্রাকে তুলে এনে বিয়ে করেছিলেন। অর্জুনের এই আচরণে যখন সুভদ্রার বাকি আত্মীয়েরা ক্রুদ্ধ, তখন তাদেরকে শান্ত করতে কৃষ্ণ যুক্তিস্বরূপ জানিয়েছিলেন যে, প্রচলিত প্রথা মেনে অর্থের বিনিময়ে পাণিগ্রহণ করার ক্ষমতা অর্জুনের নেই। মহাভারতে আরও উল্লেখ আছে, মদ্ররাজ শল্য বহু মূল্যবান সামগ্রীর বিনিময়েই মাদ্রীর বিয়ে দিয়েছিলেন পাণ্ডুর সঙ্গে। যযাতির মেয়ে মাধবীকে পাওয়ার জন্য গালবকে অশ্বপণ দিতে হয়েছিল। অর্থাৎ, মহাভারতের সময়ে কন্যাপণ প্রথার প্রচলন ছিল, বিয়ে করার সময়ে বরপক্ষকেই পণ দিতে হত কনেপক্ষের কাছে। এই কন্যাপণ প্রথার উদ্ভবের কারণ জানতে ভারতীয় কৃষ্টির মূলে যাওয়া প্রয়োজন। শ্রী কৃষ্ণ পণ প্রথার বিরুদ্ধে গিয়ে সমাজ কে আসল চেহারা দেখাতে চেয়েছিলেন।বিবাহের আসল উদ্দেশ্যে র কথা মনে করিয়েছেন।
আবার শোনা গিয়ে থাকে বৈদিক যুগে বিয়ের অনুষ্ঠানে, মেয়েকে তার নিজের বাড়ি থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য তো উপহার দেওয়া হতই, সঙ্গে কিছু মূল্যবান সম্পত্তিও দেওয়া হত যার উপরে অধিকার থাকতো শুধু মেয়েটিরই। তার স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির নয়। মেয়েকে এই উপহার দেওয়ার প্রথাটিই ‘কন্যাদান’, অর্থাৎ কন্যাকে করা দান বা উপহার। এই প্রথাটি ভারতীয় হিন্দু সমাজে আজও প্রচলিত। কিন্তু জনমানসে হয়তো কন্যাদান শব্দের অর্থই পাল্টে গিয়েছে এখন। কন্যাদানের সময় মেয়ের পাওয়া যাবতীয় উপহার এবং ধনসম্পত্তি, যার উপর অধিকার শুধু মেয়েটিরই, এটাই স্ত্রীধন নামে পরিচিত। এই স্ত্রীধন, অর্থাৎ মেয়ের নিজের কিছু সম্পত্তির অধিকার, বিপদের সময়ে অর্থনৈতিক সুরক্ষা সুনিশ্চিত করত। বর্তমান সমাজে কন্যা দান শব্দটি অপপ্রয়োগ করে নিজেদের স্বার্থের জন্য পাল্টে দেওয়া হয়েছে।
এবার আমাদের উচিত কন্যাদান শব্দটি র আসল অর্থ জানা।
কন্যাদান মন্ত্রটির অর্থ ,
“অবঙ্গ পতিতং ক্লিবা দশ দোশ বিমর্জিতা,
তুভ্যং কন্যা পদস্বামী দেবাগ্নি দ্বিজ সান্নিধ্যৌ”
ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর কে সাক্ষী রেখে আমি আমার কন্যাকে তোমার নিকট সমর্পন করলাম।
কন্যা দান কথার প্রকৃত অর্থ হল শিক্ষা যেমন নিরক্ষরকে শক্তি দেয় তেমনই স্ত্রীও নাকি শক্তি দেয় স্বামী কে। ছেলেদের ডান হাত শক্তিশালী তাই সেই হাত দিয়ে তারা উপার্জন করে, বাম হাত দুর্বল সেই দিকটি নাকি স্ত্রী শক্তিশালী করে।