বাঙালি বাড়িতে দৈনন্দিন আহারে যে শাকপাতা রান্না করা হয়, তাদের থেকে এদিনের শাক কিন্তু আলাদা৷ এই ১৪ শাক সম্পূর্ণ ভেষজ গুণে ভরপুর৷ আমরা অনেকেই তাদের নাম ঠিক করে জানি না৷ বাজারে যে আঁটি বিক্রি হয়, তাতেও ওষধির পরিবর্তে মিশে থাকে সাধারণ প্রচলিত শাকপাতাই৷ এই ঋতু পরিবর্তেনের সময় শরীরকে নানা সমস্যার থেকে রক্ষা করে এই ভেষজ শাকগুলি৷এই ১৪ শাকের সম্মিলিত স্বাদ তিতকুটে৷ ঋতু পরিবর্তনের সময় এই স্বাদ গড়ে তোলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা৷
চামুণ্ডারূপী চোদ্দ ভূত দিয়ে অশুভ শক্তিকে ভক্তের বাড়ি থেকে তাড়ানোর জন্যে মা কালী নেমে আসেন মর্ত্যে। ‘ভূত চতুর্দশী’ সম্পর্কে এই তথ্য আপনার জানা। এটা মূলত বাঙালি হিন্দুর উৎসব। কারণ বাংলা ছাড়া ভারতের অন্যান্য রাজ্যে হিন্দুরা সেভাবে এই ‘ভূত চতুর্দশী’ উদযাপন করে না। পশ্চিম ভারতে এই তিথিকে ‘নরক চতুর্দশী’।
আবার অন্য প্রচলিত ভূত চতুর্দশীর দিনটি ১৪ পুরুষের জন্যে উৎসর্গ করা হয়। এই বিশেষ দিনে পূর্বপুরুষরা মর্ত্যে আসেন। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, এই ১৪ পুরুষ , জল, মাটি, বাতাস ও অগ্নির সঙ্গে মিশে রয়েছেন। আর এজন্যেই মূলত মাটির মধ্যে জন্মানো ১৪ টি বিশেষ শাক খেয়ে ১৪ পুরুষদের উৎসর্গ করা হয় ভূত চতুর্দশীর দিনটি।
আবার পূরাণ মতে ভূত চতুর্দশীর রাতে শিবভক্ত বলি, মর্ত্যে আসেন পুজো নিতে। সঙ্গে আসেন তাঁর অনুচর ভূতেরা। চতুর্দশী তিথির ভরা অমাবস্যায় চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকে। সেই ঘন অন্ধকারে যাতে বলি রাজার অনুচরেরা বাড়িতে ঢুকে না পড়েন, তার ব্যবস্থাই করা হত প্রাচীন কালে।
মর্ত্যবাসীরা মাকালীর সঙ্গে আসা ভূতপ্রেতদের দূরে রাখতে ১৪ শাক খেয়ে, ১৪ প্রদীপ জ্বালিয়ে এবং ১৪ ফোঁটা দিয়ে এই তিথিকে উদযাপন করে থাকে। এই ১৪ শাক হল- ওল, বেতো, সরষে, নিম, গুলঞ্চ, শুষণী, হিলঞ্চ, জয়ন্তী, শাঞ্চে, কালকাসুন্দে, পলতা, ভাটপাতা, কেঁউ, এবং শৌলফ। এমনিতেও এই সময়ে নানা ধরনের শাক-সবজি খাওয়া শরীরের পক্ষে ভাল, তাই ১৪ শাক খাওয়া ভাল। দীপান্বিতা কালী পুজোর আগের দিন অর্থাৎ চতুর্দশী এর ক্ষণ পরে গেলেই প্রতি বাড়িতে ১৪ টি প্রদীপ জ্বালিয়ে ১৪ পুরুষের উদ্দেশ্যে বাতি দেওয়া হয়। ঘর বাড়ি উঠোন এবং সর্বত্রই ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ভূত অর্থাৎ অতীত, এবং চতুর্দশী অর্থাৎ কৃষ্ণপক্ষের ১৪ তম দিন। পিতৃ এবং মাতৃকুলের সাত পুরুষের উদ্দেশ্যে বাতি প্রদান। পুরাণ মতে, এইদিন মহাকালী ধীরে ধীরে জাগ্রত হতে শুরু করেন। অশুভ শক্তির বিনাশের পূর্বক্ষণ এই ভূত চতুর্দশী। হিসেবমত সমস্ত প্রদীপ ঘিয়ের হওয়া উচিত কিন্তু বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে তেলের শিখা ব্যবহার করা হয়। দীপাবলি উপলক্ষে যেমন চারিদিকে অন্ধকার ঘুঁচে গিয়ে আলোয় ভরে ওঠে তেমনই ভূত চতুর্দশী- এই বিশেষ দিনে আত্মা প্রেতাত্মার বিনাশের শুরু। চোদ্দ রকমের গাছের পাতা সঙ্গে বাদাম এবং বড়ী মিশিয়ে সকলকেই এটি খেতে হয়। কথিত আছে, এক ব্রাহ্মণ এবং তাঁর স্ত্রী দুজনেই নিজেদের বাসভবন পরিষ্কার না করে দিনের পর দিন নোংরা করে রাখতেন। এবং সেখানেই নানান ভূতের আগমন ঘটতে থাকে। হঠাৎ একদিন সেই বামুনের নজরে আসে ভূতেদের শোরগোল। ব্যাস! ওমনি মাথায় হাত আর সঙ্গে সঙ্গেই শুরু করলেন বাড়ির দেখভাল। নতুনভাবে সবকিছুই পরিষ্কার করলেন বটে, তেমনই ১৪ রকম গাছের পাতার সহযোগে সারা বাড়িতে গঙ্গার জল ছিটিয়ে শুদ্ধ করার প্রয়াসও করেন। সেইদিনের পর থেকেই কিন্তু ভূত চতুর্দশী উপলক্ষে ১৪ শাক খাওয়ার চল।
শাকের গুণাগুণ –
ওল- সব্জি হিসেবে খেলেও আমরা অধিকাংশই এর পাতা বা শাক কেমন দেখতে চিনি না ৷ খাওয়া যায় ওলের ডাঁটাও৷ আয়ুর্বেদ শাস্ত্র মতে, ওলশাক রক্ষা করে মরসুমি ঠান্ডা লাগা এবং সর্দিকাশির হাত থেকে৷ অরুচি দূর করে৷ পরিপাকক্রিয়া স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে ওলশাক।
কেঁউ- গুল্মজতীয় এই গাছ ঝোপঝাড়েই বেশি জন্মায়৷ কৃমির সমস্যা কমাতে, অখিদে দূর করতে আয়ুর্বেদশাস্ত্রে কেঁউশাকের গুরুত্ব আছে৷ এছাড়া চর্মরোগ নাশ করার জন্যও এই শাক উপকারী৷ নিয়মিত সেবনে বাড়ে ত্বকের লাবণ্যও৷
বেতো- লিভারকে সুস্থ রাখতে বেতো শাক জুড়িহীন৷ এছাড়া অখিদে, কৃমির সমস্যা, পাইলসের যন্ত্রণা উপশমেও কার্যকর এই শাক৷ কিডনিতে পাথর হলে বা মূত্রত্যাগের সময় প্রদাহ অনুভব করলে বেতো শাকের রস খেলে আরাম পাওয়া যায়।
সর্ষে- এই শাক খাওয়ার চল আছে অবাঙালি পরিবারেও৷ পঞ্জাবি রান্নার ‘সর্ষো কি শাগ’ ভেষজ গুণের আধারও৷ এই শাক খেলে রক্তে উপকারী কোলেস্টেরল বা গুড কোলেস্টেরল বাড়ে৷ দেহে ভিটামিন ডি তৈরি করতে সাহায্য করে৷
কালকাসুন্দে- অ্যালার্জি-সহ ত্বকের যে কোনও সংক্রমণ, কোষ্ঠকাঠিন্য, জ্বর ও ক্ষত নিরাময়ের জন্য এই গুল্মপাতা ব্যবহৃত হয়৷ সর্দিকাশি জ্বরে এই পাতার রস দেওয়া হয়৷ অরুচি এবং পেটের রোগ কমাতেও এই শাক উপকারী৷
নিম-এই পাতার উপকারিতা তো বলে শেষ করা যায় না৷ মধুমেহ এবং পেটের রোগ প্রশমনে নিমপাতার মতো কার্যকারিতা বিরল৷ নিয়মিত নিমের রসে উজ্জ্বল থাকে ত্বক৷ বাচ্চাদের কৃমির সমস্যা দূর করতেও নিমের রস খেতে বলা হয়৷
জয়ন্তী- এই গুল্মও ঝোপঝাড়ে জন্মায় ৷ অনাদরে পড়ে থাকা এই পাতা সঠিক ভাবে ব্যবহার করলে বহু সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া যায়৷ সারতে না চাওয়া একঘেয়ে কাঁচা সর্দি, নাক বন্ধ এবং মাথা ভার হয়ে থাকার সমস্যায় কার্যকর এই পাতা৷ মধুমেহ নিয়্ন্ত্রণেও এই পাতার রস ব্যবহার কর হয়৷
শাঞ্চে- সাঞ্চি বা মালঞ্চ শাক নামেও পরিচিত ৷ জলা জায়গায় জন্মানো এই শাক পেট ঠান্ডা রাখে৷ পরিপাক ক্রিয়ায় সাহায্য করে৷ অখিদে দূর করে খিদে বাড়ায়৷ প্রচুর ফাইবার থাকায় এই শাকের জন্য রক্তে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রিত হয়৷ আয়রন সমৃদ্ধ বলে রক্তাল্পতাও প্রতিরোধ করে৷
হিলঞ্চ-এই শাককে অনেকে ডাকেন হিঞ্চে বলেও৷ আয়ুর্বেদ মতে, এই শাক রক্তশোধক এবং ক্ষুধাবর্ধক৷ পাশাপাশি, পিত্ত সমস্যাতেও কার্যকর৷ রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বাড়াতেও সাহায্য করে এই শাক৷
পলতা- পটলের পাতাই পরিচিত পলতাপাতা নামে৷ খিদে ও হজমশক্তি দুই-ই বাড়ায় এই পাতার তিক্ত স্বাদ৷ নিয়মিত খেলে দূর হয় কোষ্ঠ্যকাঠিন্য৷শৌলফ- পুরনো ক্ষত, জ্বর, চোখের সংক্রমণ উপশমে এই পাতার রস কার্যকর৷ মাতৃদুগ্ধের পরিমাণ বাড়াতে এবং বাচ্চদের পেটের গণ্ডগোল সারাতে এই শাক দেওয়া হয় আয়ুর্বেদ চিকিৎসায়৷
হিলঞ্চ – এই শাককে অনেকে ডাকেন হিঞ্চে বলেও৷ আয়ুর্বেদ মতে, এই শাক রক্তশোধক এবং ক্ষুধাবর্ধক৷ পাশাপাশি, পিত্ত সমস্যাতেও কার্যকর৷ রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বাড়াতেও সাহায্য করে এই শাক৷পলতা- পটলের পাতাই পরিচিত পলতাপাতা নামে৷ খিদে ও হজমশক্তি দুই-ই বাড়ায় এই পাতার তিক্ত স্বাদ৷ নিয়মিত খেলে দূর হয় কোষ্ঠ্যকাঠিন্য৷
শৌলফ – পুরনো ক্ষত, জ্বর, চোখের সংক্রমণ উপশমে এই পাতার রস কার্যকর৷ মাতৃদুগ্ধের পরিমাণ বাড়াতে এবং বাচ্চদের পেটের গণ্ডগোল সারাতে এই শাক দেওয়া হয় আয়ুর্বেদ চিকিৎসায়৷
আমাদের লেখা কেমন লাগলো অবশ্যই comment box এ জানাবেন। ধন্যবাদ