ইতু’র অপর নাম মিত্র। অগ্রহায়ণ মাসে সূর্য বৃশ্চিক রাশিতে অবস্থান করে এবং এই অবস্থানে সূর্যের নাম মিত্র। রবিবার পুজো করা হয় বলে প্রতি রবিবার উপবাস রেখে পুজো করা হয় বলে একে সূর্যের পুজোও বলা হয়ে থাকে। ইতু পুজোকে সূর্য উপাসনা বলা হলেও এই পুজোর রীতিও উপাচার বিশ্লেষণ করে ইতুকে মাতৃদেবী রূপেই গণ্য করেন অনেকে। ইতুর ঘটের গায়ে সিঁদুর দিয়ে আঁকা হয় এবং ভেতরে দেওয়া হয় শস্যদানা ও তৃণগুচ্ছ। খড়ের বিঁড়ের উপরেই ইতুর সরাকে বসানো হয়। এর পর ওই সরাতে দেওয়া হয় মাটি। মাটি পূর্ণ সরার মাঝে ঘট স্থাপন করতে হয়। আর বাকি অংশে থাকে কলমী, সরষে, শুষনীর মূলসহ শাক। এ ছাড়া ধানের বীজ, মানকচুর মূল লাগানো হয়। আর ছোলা মটর মুগ তিল যব সহ আট রকমের শস্যের বীজও ছড়ানো হয়ে থাকে।
ইতু গ্রাম বাংলার লক্ষ্মীর সঙ্গে মিশে হয়ে উঠেছেন শস্য, সৌভাগ্য আর মঙ্গলের প্রতীক। কুমারী মেয়েদের পতিলাভ বা বিবাহিত মেয়েদের সন্তানলাভের আকাঙ্ক্ষা তথা সংসারের কল্যাণ কামনাতেও ইতু পুজো বহু প্রাচীন কাল থেকে হয়ে চলেছে গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে। পুজো শেষে সবাই গোল হয়ে শুনতে বসে ব্রতকথা। ইতুব্রতকথায় বলা হয়েছে, অষ্টচাল অষ্টদুর্বা কলসপত্র ধরে। ইতুকথা একমনে শুন প্রাণ ভরে।বাংলা মেয়েরা নিজেরাই এই পুজো করে থাকেন। ইতুকে সাধভক্ষণের প্রথাও রয়েছে কোথাও কোথাও। সেদিন নতুন গুড় ও চাল দুধ দিয়ে পরমান্ন তৈরি করে নিবেদন করা হয়।
ইতু পুজোর মন্ত্র:
“ইঁয়তি ইঁয়তি নারায়ণ,
তুমি ইঁয়তি ব্রাহ্মণ।
তোমার শিরে ঢালি জল,
অন্তিম কালে দিও ফল।”
উপকরণ:
একটি সুন্দর মাটির সরা তে মাটি ভরে তার মধ্যে দুটি ঘট ,সুপারি, মান, কচু, কলমীলতা, হলুদ, আখ, শুষনি, সোনা ও রুপোর টোপর, জামাই-নাড়ু, শিবের জটা, কাজললতা রেখে ফুলের মালা, ধূপ-দ্বীপ-সিঁদুর প্রভৃতি পুজোর উপকরণ ও ফল-মিষ্টান্ন ও নবান্ন। আরো অনেকে অনেক কিছু দিয়ে সাজিয়ে এই প্রথা করে থাকেন।
মেয়েরা অগ্রহায়ণ মাসের প্রতি রবিবার ইতু ঠাকুরের পুজো করে থাকেন। ইতু পুজোর নিয়ম প্রসঙ্গে বলা হয়েছে কার্ত্তিক মাসের সংক্রান্তি থেকে অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তি পর্যন্ত পুজোর নিয়ম। অগ্রহায়ণ মাসের প্রতি রবিবারে পুজো করে সংক্রান্তির দিন পুজো করতে হয়। এই পুজো দুই ভাবে পালিত হতে পারে৷ প্রথমতঃ -কার্তিক মাসের সংক্রান্তি তে শুরু করে, অগ্রহায়ণ মাসের সব কটি রবিবার পালন করে, অগ্রহায়ণ সংক্রান্তি তে পুজো করে ব্রত উদযাপন করা যায়৷ অপরপক্ষে শুধুমাত্র অগ্রহায়ণ সংক্রান্তিতে ব্রত পালন ও উদযাপনও কোন কোন পরিবারের নিয়ম থাকে৷
অগ্রহায়ণ সূর্য বৃশ্চিক রাশিতে অবস্থান করে এবং এই অবস্থানে সূর্যের নাম মিত্র। রবিবার পুজো করা হয় বলে সূর্যের পুজো বলা হয়।
ইতুকে লক্ষ্মী নামে অভিহিত করা হয়৷ বলা হয় ইতু লক্ষ্মী৷ আসলে সূর্য্যের অকৃপণ দাক্ষিণ্যে, ধান ও সমৃদ্ধি রূপিনী দেবী লক্ষ্মীর আরাধনাই ইতু পুজো৷ প্রভাবে সূর্য দেব এখানে লক্ষ্মীদেবীতে রূপান্তরিত হয়েছেন৷ তাই, মনে হয় সূর্যের অকৃপণ দাক্ষিণ্যে ধন ও সম্পদ রূপিনী দেবী দেবী লক্ষ্মী ইতু রূপে পূজিত হচ্ছেন৷ সূর্যব্রত ভারতের সকল নারী সমাজের একটি প্রধান ব্রত। সূর্য উর্বরা শক্তির আধার, সেজন্য সূর্যকে প্রসন্ন করার প্রয়াস।
বাংলার মেয়েরা ইতুকে শস্যের দেবী হিসেবেই পূজা করে থাকে। এই পুজোর রীতি ও উপাচার বিশ্লেষণ করে ইতুকে মাতৃকাদেবী রূপেই গণ্য করে অনেকে।মেয়েরা নিজেরাই এই পুজো করে থাকেন। প্রার্থনা জানান মনের ইচ্ছা র কথা মা ইতু জানায়।
শীতকালীন চাষের আগে রবিশস্যের বীজ সংগ্রহই ছিল ব্রতপালনের উৎস। বিবাহিত ও অবিবাহিত‚ সব মেয়েই এই ব্রত পালন করতে পারে। একবার ব্রত শুরু করলে পালন করতে হয় আজীবন। যতদিন না ব্রতপালনের ভার মেয়ে বা পুত্রবধূ নিচ্ছে‚ ততদিন ব্রতধারীকে পালন করতেই হবে ইতুপুজো।
প্রতি রবিবার পুজোর সময় বেশি ভাগ ব্রতচারী রা নিরামিষ ভোজন করে থাকেন।
মাটির ছোট ঘটকে লাল সাদা রঙে সাজানো হয়। সেখানে বীজ বপন করা হয়। চারাগাছ অঙ্কুরিত হলে ধরে নেওয়া হয় তা সংসারের সুখ সমৃদ্ধির প্রতীক।
দুধ ময়দা আর ফলের নানাবিধ প্রসাদে সাজানো হয় নৈবেদ্য। একে বলা হয় ইতুর সাধ। পুজোর পরে প্রসাদ বিতরণ করা হয় । সবার শেষে ব্রতকথা পাঠ করে পুজো সমাপ্ত হয়।
ইতুপুজোর ব্রতকথা
এক গ্রামে ছিল এক গরিব ব্রাহ্মণ। দিন চলত ভিক্ষা করে। একদিন সাধ হল পিঠে খাবেন। বহু কষ্টে ভিক্ষা করে যোগাড় করলেন সরঞ্জাম। সন্ধেবেলা উপকরণ এনে দিলেন ব্রাহ্মণীকে।রান্নাঘরে ব্রাহ্মণী বসে পিঠে ভাজে। একবার ‘ ছ্যাং‘ শব্দ পেলেই দাওয়ায় বসে ব্রাহ্মণ গুনে নেন। হিসেব রাখেন মোট কটা পিঠে হল।রাতে খেতে বসে দেখেন দুটো পিঠে কম। বামুন তো রেগে যায়। ভয়ে ভয়ে বামনি জানাল সে দুটো পিঠে দিয়েছে দুই মেয়ে উমনো আর ঝুমনোকে। সে রাতের মতো বামুন বাকি পিঠে সব খেল।পরদিন দুই মেয়েকে নিয়ে বের হল বোনের বাড়ি যাওয়ার নাম করে। দুই মেয়েকে কয়েক ক্রোশ পথ হাঁটাল। খিদে পিপাসায় কাতর হয়ে পথেই ঘুমিয়ে পড়ল উমনো ঝুমনো। পথের ধারে এক গাছতলায় ঘুমন্ত দুই মেয়েকে ফেলে বাড়ি চলে এল ব্রাহ্মণ।
রাতে ঘুম ভেঙে গেল দুই বোনের। বড় বোন উমনো ভাবল বাবাকে বোধহয় বাঘে খেয়েছে। ঝুমনো কিন্তু ঠিক বুঝতে পারল পিঠে খাওয়ার অপরাধে তাদের পরিত্যাগ করেছে বাবা।কোনওমতে ভয়ে ভয়ে রাত কাটিয়ে সকালে দুই বোন হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছল এক গ্রামের ধারে। সেখানে ইতুব্রত পালন করছিল কিছু কিশোরী। উমনো ঝুমনোকে দিশেহারা দেখে তারা এগিয়ে এসে কারণ জিজ্ঞাসা করল। সব শুনে বলল ইতু ব্রত পালন করতে।
পুকুরে স্নান সেরে উমনো আর ঝুমনো তাদের সঙ্গে ইতু পুজো করল। ভক্তিভরে প্রার্থনা করল‚ যেন বাবা মায়ের সব ইচ্ছে পূর্ণ হয়। এক মাস সেই গ্রামে আশ্রয় নিয়ে থেকে ব্রত পালন করল উমনো ঝুমনো।
তারপর পুজোর ঘট হাতে দুই বোন ফিরে এল বাড়িতে। এসে দেখে‚ সংসার ভরে গেছে ধনৈশ্বর্যে। দুই মেয়েকে দেখতে পেয়ে ছুটে এসে তাঁদের জড়িয়ে ধরলেন বামনি। উমনো ঝুমনো তখন ব্যক্ত করল ইতুপুজো মাহাত্ম্য।নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হলেন স্বার্থপর ব্রাহ্মণ। বুঝলেন দুই মেয়ের ভক্তিতেই আজ তাঁর এত সমৃদ্ধি। মেয়েদের কাছে শিখে ব্রাহ্মণীও শুরু করলেন ইতুপুজোর ব্রত। যথাকালে উমনোর বিয়ে হল রাজপুত্রের সঙ্গে এবং ঝুমনোর মন্ত্রীপুত্রের সঙ্গে। অন্যদিকে পুত্রসন্তান এল ব্রাহ্মণীর কোল জুড়ে।
ইতুব্রত কথা হেথা হৈল সমাপন।