কামদেব হলেন হিন্দু প্রেমের একজন দেবতা। তার নামগুলি হল রাগবৃন্ত,প্রেমের অঙ্কুর, অনঙ্গ,দেহহীন, কন্দর্প,দেবগণেরও কামনা সৃষ্টিকারী, মন্মথ,মন মন্থনকারী, মনসিজ,মন হইতে জাত, সংস্কৃতে বলা হয় সঃ মনসঃ জাত, মদন,নেশা সৃষ্টিকারী, রতিকান্ত,রতির পতি, পুষ্পবাণ, পুষ্পধন্বা,পুষ্পবাণধারী এবং কাম,কামনা। অনেকের মতে কামদেব হিন্দু দেবী শ্রীর পুত্র। অন্যদিকে তিনি কৃষ্ণের পুত্র প্রদ্যুম্নের অবতার। তার স্ত্রী হলো আকাঙ্ক্ষার দেবী রতি। বৈষ্ণবরা তার আধ্যাত্মিক সত্ত্বাটিকে কৃষ্ণের সমরূপ মনে করেন।সংস্কৃত কামদেব শব্দটির অর্থ দিব্য প্রেম অথবা একজন প্রেমের দেবতা। অর্থাৎ মানুষের মনে কাম দেন যে সত্তা। দেব শব্দের অর্থ দিব্য বা স্বর্গীয়, আর কাম শব্দের আক্ষরিক অর্থ ইচ্ছা, কামনা অথবা বাসনা পূরণ, বিশেষত শারীরিক প্রেম বা যৌনতার ক্ষেত্রকে বোঝানো হয়। বিষ্ণুপুরাণ এবং ভাগবত পুরাণে দেবতা কাম্যদেব বিষ্ণুর অপর নাম কামদেব। শব্দটি কখনো কখনো দেবদা মদন এবং শিবের নাম হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। আবার সংস্কৃত গ্রন্থ প্রায়শ্চিত পদ্যত এর রচয়িতার নামও কামদেব। অন্যদিকে কৃষ্ণের অপর নাম কামদেব, কখনো কখনো আবার শব্দটি কৃষ্ণের উপাধি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। অগ্নির অপর নাম কাম। এই নামটি ঋগ্ববেদেও ব্যবহৃত হয়েছে ঋগ্বেদ ।যার অথর্ববেদে কাম যৌনাকাঙ্ক্ষা অর্থে নয় বরং সমস্ত পৃথিবীর মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।কামদেবকে এক পক্ষধারী সুদর্শন যুবকরূপে কল্পনা করা হয়। কামদেবের নাসিকা সুচারু, ঊরু, কটি এবং জঙ্ঘা সুবৃত্ত কেশ নীলাভ ও কুঞ্চিত। তার বক্ষ সুবিশাল। তার চক্ষু, মুখ পদতল এবং নখ রক্তাভ। গায়ে বকুলের ঘ্রাণ। মকর এর বাহন। তার হাতে থাকে ধনুর্বাণ। তার ধনুকটি ইক্ষুনির্মিত এবং সেই ধনুকের গুণটি মৌমাছি দিয়ে তৈরি। তার বাণ পাঁচ প্রকারের সুগন্ধী পুষ্পনির্মিত।সেই পাঁচ প্রকার পুষ্প হলো অশোক, শ্বেত এবং নীল পদ্ম, মল্লিকা ও আম্রমঞ্জরী।
- হিন্দু পুরাণোক্ত কামদেব বা মদন প্রেম ও কামের দেবতা। এঁর কীর্তি-কাহিনি কথিত হয়েছে বিভিন্ন পুরাণে। শোনা যায়, সতীর দেহত্যাগের পরে কামদেবের তিরে আহত হয়েই পার্বতীর প্রতি আকৃষ্ট হন শিব। অবশ্য কৃষ্ণের উপর কামদেবের কোনও প্রভাব খাটেনি। অজস্র গোপিনীর সঙ্গে রাসলীলায় মত্ত হওয়ার পরেও কৃষ্ণের মনে গোপিনীদের প্রতি বিন্দুমাত্র কামবাসনা জাগ্রত হয়নি। কিন্তু তেমন ইন্দ্রিয়জয়ী পুরুষ আর ক’জন হতে পারেন। ফলে কামদেবের ধনুকের তিরের প্রভাব আপামর জীবজগতের উপরই কার্যকর।পুরাণ মতে মদন হলেন ভগবান বিষ্ণু ও দেবী লক্ষ্মীর সন্তান। প্রেমের দেবী রতি তাঁর স্ত্রী। তবে কোনও কোনও পুরাণকাহিনিতে মদনকে ব্রহ্মার সন্তান হিসেবেও ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই বিষয় নিয়ে মতো ভেদ আছে।সন্তান তিনি যাঁরই হোন না কেন, তাঁর কাজ জীবজগতে কাম ও প্রেমের জন্ম দেওয়া। জীবজগতের স্থিতির জন্য কাম ও প্রেমের অবদান অনস্বীকার্য। তাই হিন্দু ধর্মে মদনকে গন্ধর্ব বা অর্ধদেবের মর্যাদা দেওয়া হয়ে থাকে। মনে করা হয়, কামদেবকে সন্তুষ্ট করতে পারলে নিজের বা়ঞ্ছিত মানুষকে আকর্ষণ করে নিতে পারেন যে কেউ। এবং কামদেবকে সন্তুষ্ট করার একমাত্র উপায় তাঁর পুজো নয়, বরং উপযুক্ত উপচার সহ কামদেব মন্ত্র জপ করলেও বাঞ্ছিত মানুষকে লাভ করা সম্ভব। প্রকৃত অর্থে কামদেব মন্ত্র হল এক ধরনের মায়াবী মন্ত্র। অর্বাচীন কালের তন্ত্রাচারে এই মন্ত্রের প্রয়োগ রয়েছে বলে শোনা যায়। বলা হয়, কাম্য নারী বা পুরুষকে আকর্ষণ, পুরনো প্রেমকে ফিরে পাওয়া, কিংবা প্রেমের বাধা দূরীকরণের মতো কার্যসিদ্ধি সম্ভব এই মন্ত্রের সাহায্যে। শোনা যায়, কোনও এক শুক্রবারে শুরু করতে হয় এই মন্ত্রের জপ। প্রথমে ফুল ও ধুপ-ধুনো সহ পুজো সারতে হয় কামদেবের।তারপর প্রজ্জ্বলিত করতে হয় বিশুদ্ধ ঘি-এর দীপ। তারপর একটি কাগজে নিজের ভালবাসার মানুষের নাম লিখে শুরু করতে হয় মন্ত্রোচ্চারণ। মন্ত্রটি এরকম: ‘‘ওম কামদেবায় কামবশম করায় অমুকস্য প্রার্থিত ব্যক্তির নাম হৃদয়ম স্তম্ভয়’’ । এই মন্ত্র উচ্চারণ করতে হয় ১০৮ বার। এমনটা টানা তিন সপ্তাহ রোজ করতে পারলেই নাকি কাঙ্ক্ষিত মানুষ ধরা দেবে মন্ত্রজপকারীর কাছে।
- বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই মন্ত্র-তন্ত্রের কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে না। কিন্তু তন্ত্রশাস্ত্রে এটাও বলা হচ্ছে , মন্ত্রজপকারীর ভালবাসা যদি খাঁটি হয়, এবং যাকে সে কামনা করছে সে যদি সত্যিই তার প্রাপ্য হয়, তবেই একমাত্র কাজ করবে এই মন্ত্র। আসলে এটাই বড় কথা। ভালবাসা খাঁটি না হলে যে ভালবাসার মানুষকে কাছে পাওয়া যায় না, কিন্তু এই বিষয়ে নিয়ে অনেকে র অনেক মতো ভেদ আছে।
- কামদেবের পাঁচবানের নাম হল 1 উন্মাদনম 2 তাপনম 3 শোষনম 4 স্তম্ভনম 5 সম্মোহনম । এই হচ্ছে পঞ্চবান
কালিকা পুরাণের মতে ব্রহ্মা দক্ষ ও অন্যান্য ঋষিদের সৃষ্টি করার পর, তিনি মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য পুলহ, ক্রতু, বশিষ্ঠ, ভৃগ ও নারদকে সৃষ্টি করেন। এই সময় তাঁর মন থেকে একটি অপরূপা নারীর জন্ম হয়। ব্রহ্মার ধ্যানের সময় উৎপন্না বলে এর নাম রাখা হয়েছিল সন্ধ্যা। এই নারীকে দেখে সবাই মোহিত হয়ে পড়লে, ব্রহ্মা এর উপযুক্ত পাত্রের কথা ভাবতে থাকেন। এই সময় তাঁর মন থেকে যে চঞ্চল প্রকৃতির পুরুষের জন্ম হয়। জন্মের পর এই পুরুষ ব্রহ্মার কাছে‒ নাম, থাকার স্থান এবং উপযুক্ত স্ত্রী কামনা করেন। উত্তরে ব্রহ্মা বলেন যে‒ স্ত্রী-পুরুষদের মোহিত করে চিরস্থায়িনী সৃষ্টির প্রবর্তক হও। দেব, গন্ধর্ব, কিন্নর, সর্প, দৈত্য, দানব, বিদ্যাধর, রাক্ষস, যক্ষ, পিশাচ, ভূত, বিনায়ক, গুহ্যক, সিদ্ধ, মনুষ্য, পশু, পক্ষী, মৃগ, কীট, পতঙ্গ এবং জলজ প্রাণিগণ, সকলেই তোমার শরের শিকার হবে। অন্য প্রাণী তো বটেই, আমি (ব্রহ্মা), বিষ্ণু এবং মহাদেব আমরাও তোমার বশবর্তী হব।
পরে উপস্থিত ঋষিরা এঁর নামকরণ করেন। ব্রহ্মার চিত্ত মথিত করে উৎপন্ন হয়েছেন বলে, তাঁর নাম মন্মথ। অসাধারণ এবং অতুলনীয় কামরূপী পুরষ অর্থে‒ এঁর নাম কাম। লোকের মন মত্ত করেন বলে‒ তাঁর নাম মদন। মহাদেবের দর্প নাশ করতে সমর্থ বলে‒ ইনি দর্পক এবং কন্দর্প। এরপর কামদেব তাঁর কামশরের গুণাগুণ পরীক্ষা করার জন্য ব্রহ্মা, দক্ষসহ অন্যান্য প্রজাপতি ও ব্রহ্মার সকল মানসপুত্রদের উপর কামের বাণ নিক্ষেপ করে মোহিত করেন। এর ফলে ব্রহ্মা নিজ কন্যা সন্ধ্যাকে কামনা করেন। এই সময় আকাশচারী মহাদেব ব্রহ্মাকে বলেন যে‒ পুত্রবধূ এবং কন্যা মাতৃতুল্যা। সামান্য কামের প্রভাবে ব্রহ্মার এই বিকারকে মহাদেব উপহাস করেন। পরে ব্রহ্মা সংযত হয়ে‒ মহাদেবকে বলেন যে, কাম অচিরেই আপনার উপর এই ক্ষমতা প্রয়োগ করে‒ আপনার নয়ন অনলে ভস্মীভূত হবে।
এরপর কামদেব, ব্রহ্মার কাছে তাঁর পরীক্ষার কথা অকপটে শিকার করেন এবং নিজেক নিরাপরাধ দাবী করে এর প্রতিকার চান। ব্রহ্মার বলেন‒ মহাদেবের তৃতীয় নয়নে ভস্মীভূত হওয়ার পর, পুনরায় তাঁর আবার শরীর লাভ হবে। এরপর ব্রহ্মা অন্তর্হিত হলে- দক্ষ তাঁর নিজ স্বেদজল থেকে উৎপন্ন কন্যাকে মদনের সামনে এনে রতি নামে পরিচয় করিয়ে দেন এবং কামদেবের হাতে রতিকে সমর্পণ করেন।
মৎস্যপুরাণে আছে‒ ব্রহ্মার হৃদয় থেকে এঁর জন্ম হয়েছিল। পরে ব্রহ্মা এঁরই শরে জর্জরিত হয়ে নিজ কন্যা শতরূপাকে গ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তী সময় ব্রহ্মা তাঁকে এই অভিশাপ দেন যে— ইনি মহাদেবের ক্রোধে ভস্মীভূত হবেন। পরে এঁর কাতর প্রার্থনায় প্রসন্ন হয়ে ব্রহ্মা অপর একটি বর দিয়ে বলেন, কাম প্রথমে শ্রীকৃষ্ণের পুত্ররূপে জন্মাবেন এবং এরপর ভরতবংশে জন্মগ্রহণ করবেন। এরপর বিদ্যাধরের পিতা হবেন এবং সবশেষে দেবত্ব লাভ করবেন।
তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে আছে— ইনি ধর্মের ঔরসে এবং শ্রদ্ধার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। হরিবংশের মতে ইনি লক্ষ্মীর পুত্র মায়ী নামে অভিহিত হয়েছেন।
শ্রীমদ্ভাগবত ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের মতে- সতী দেহত্যাগের পর হিমালয়ের কন্যা পার্বতীরূপে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। ইনি মহাদেবকে পতিরূপে পাওয়ার জন্য তপস্যা শুরু করেন। এই সময় মহাদেব গভীর তপস্যায় মগ্ন ছিলেন। পার্বতী সে কথা জানতে পেরে প্রতিদিন তাঁর পূজা করতে থাকেন। এদিকে তারকাসুর নামক এক অসুর ব্রহ্মার বরে বলীয়ান হয়ে, দেবতাদের উপর পীড়ন শুরু করলে— দেবতারা ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন। ব্রহ্মা দেবতাদের জানান যে, শুধু মাত্র মহাদেবের ঔরসজাত সন্তানই এই অসুরকে হত্যা করতে পারবেন। মহাদেবের ধ্যানভঙ্গের জন্য, অন্যান্য দেবতাদের অনুরোধে কামদেব হিমালয়ে গিয়ে তাঁর কন্দর্প বাণ নিক্ষেপ করেন। ফলে মহাদেবের ধ্যান ভঙ্গ হয়। এতে মহাদেব ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর তৃতীয় নয়ন উন্মোচিত করে কামকে ভস্মীভূত করেন। এরপরে মহাদেব অনুতপ্ত হয়ে কামদেবকে প্রদ্যুম্নরূপে জন্মগ্রহণ করতে বলেন। মহাদেবের তৃতীয় নেত্রে ভস্মীভূত হয়ে ইনি অঙ্গহীন হয়েছিলেন বলে এর অপর নাম অনঙ্গ।
ইনি পুষ্পময় পাঁচ প্রকার শর দ্বারা শোভিত। এই পাঁচটি শর হলো— সম্মোহন, উন্মাদন, শোষণ, তাপন, স্তম্ভন। এই পাঁচটি শর পাঁচটি ফুলের প্রতীকে শোভিত। এই ফুলগুলি হলো– অরবিন্দ, অশোক, আম্র, নবমল্লিকা বা শিরিষ ও নীলোৎপল।
প্রেমের দেবতা সম্পর্কে জেনে কেমন লাগল অবশ্যই Comment Box এ জানাবেন। ধন্যবাদ