মা মঙ্গলচণ্ডী, যাঁহার নাম মধুর ও মনোহর, যাঁহার হস্তে বর ও অভয় মুদ্রা, যিনি দ্বিভুজা ও গৌরবর্ণা, যিনি রক্তপদ্মাসনে উপবিষ্টা ও মুকুট দ্বারা উজ্জ্বলরূপে ভূষিতা, যিনি রক্তবর্ণ কৌষেয় (চেলির) বস্ত্র পরিধান করিয়া আছেন, যিনি সহাস্যবদনা, সুন্দরাননা ও নবযৌবনা, যিনি সুন্দরাঙ্গী ও মধুর লাবণ্যযুক্তা, তিনিই দেবী মঙ্গলচণ্ডী।বিশ্বের মূল স্বরূপা প্রকৃতিদেবীর মুখ হ’তে মঙ্গলচণ্ডী দেবী উৎপন্না হয়েছেন। তিনি সৃষ্টিকার্য্যে মঙ্গলরূপা এবং সংহারকার্য্যে কোপরূপিণী, এইজন্য পণ্ডিতগণ তাঁকে মঙ্গলচণ্ডী বলিয়া অভিহিত করেন।” “দক্ষ অর্থে চণ্ডী এবং কল্যাণ অর্থে মঙ্গল। মঙ্গলকর বস্তুর মধ্যে দক্ষ বলে তিনি মঙ্গলচণ্ডী নামে প্রসিদ্ধ। প্রতি মঙ্গলবারে তাঁহার পূজা বিধেয়। মনু বংশীয় মঙ্গল রাজা নিরন্তর তাঁহার পূজা করিতেন।”
মঙ্গলচণ্ডী ব্রতের নিয়ম
জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রতি মঙ্গলবার এই ব্রত পালন করতে হয়। এই ব্রত পুরোহিত দ্বারা করতে হয়। পুরোহিতকে সাধ্যমত দক্ষিণা, আম, সুপুরি, কাঁঠাল, কলা ইত্যাদি দিতে হয়। চিঁড়ে দই ইত্যাদি দিয়ে পুরোহিতকে ফলার খাইয়ে, সেই ফলারের অর্ধাংশ ব্রতী নিজে খেয়ে দিন কাটাতে হবে। ব্রত শেষে ব্রতকথা পাঠ বা শ্রবণ করতে হবে।
কেন এই ব্রতের নাম মঙ্গলচণ্ডী ব্রত
জৈষ্ঠ্যমাসের প্রতি মঙ্গলবারে মা চণ্ডীর আরাধনা করা হয় বলে এ ব্রতের নাম মঙ্গলচণ্ডী ব্রত। জীবনে শ্রেষ্ঠ মাঙ্গল্যের প্রতিষ্ঠার জন্যই এ ব্রতের অনুষ্ঠান। মঙ্গলচণ্ডী ব্রতের নানা রূপ আছে। কুমারীরা যে মঙ্গলচণ্ডী ব্রতের আচরণ করে, তা অতি সহজ ও সংক্ষিপ্ত। দেবী অপ্রাকৃত মহিমার প্রশস্তিগীতি ব্রতের ছড়ায় এসে ধরা দেয়।
তাহলে এবার আসা যাক.. জয় মঙ্গলচন্ডীর ব্রতকথা নিয়ে..
দেবীর প্রকৃত মন্ত্র হলো
” জৈসা ললিত কান্তাক্ষা,দেবী মঙ্গল চন্ডীকা।
বরদাভয় হস্তা চ দ্বিভুজা গৌর দেহিকা, রক্তবস্ত্র শনস্থা চ রতনৌজ্জ্বল মন্ডিতা ।।
রক্তকৌশীয় বসনা স্মিত বক্ত্রা শুভাননা, নব যৌবন সম্পনা, চারবঙ্গীন ললিতপ্রভা।।
ঔঁ হ্রীং স্রীং মঙ্গলচন্ডীকায়ৈ নমঃ।
”জয় মঙ্গলবারের ব্রতকথাঃএক দেশে একজন সওদাগর আর একজন বেনে বাস করত। সওদাগরের সাত ছেলে, একটিও মেয়ে হয়নি। বেনের আবার সাত মেয়ে, ছেলে হয়নি। ‘একদিন মা মঙ্গলচণ্ডী বৃদ্ধ ব্রাহ্মণীর বেশধরে ছলতে গেল। আগে গেলেন বেনের বাড়ি ; গিয়ে বললেন,
ওমা! দুটি ভিক্ষা দাও গো।
বেনেবউ তাড়াতাড়ি ভিক্ষা নিয়ে এলহ ব্রাহ্মণী বললেন,
‘তোমার কটি ছেলে, কটি মেয়ে মা? ‘আমার সাতটি মেয়ে, ছেলে হয়নি বাছা! ‘’ছেলে হয়নি! আমি ছেলে – আটকুড়র মুখ দেখিনা, মেয়ে – আঁটকুড়ার ভিক্ষা লই না। ‘এই বলে ব্রাহ্মণী যেমনি চলে যাবে, অমনি বেনে বউ পায়ে ধরে কাঁদতে লাগল। ব্রাহ্মণী একটি একটি ফুল দিয়ে বললেন, এই ফুল ধুয়ে জল খেলে তোমার ছেলে হবে, নাম রেখো জয়দেব। ‘এই বলে সেখান থেকে সওদাগরের বাড়ি চলে গেলেন। সেখানে গিয়ে অনুরূপ ভাবে ভিক্ষা চাইলেন। সওদাগরের বউ ভিক্ষা নিয়ে এলে ব্রাহ্মণী তা নিতে অস্বীকার করেন। কারন তিনি ছেলে আঁটকুড়ার মুখ দেখেন না। তিনি বললেন ‘এই ফলটি রেখে দাও, ধুয়ে জল খেও।তাহলে তোমার একটি মেয়ে হবে, তার নাম রেখো জয়াবতী। ‘এই কথা বলে তিনি অন্তর্ধান হলেন। তারা সেই ফল খেতে দুজনেই অন্তঃসত্ত্বা হল। সওদাগরের মেয়ে হল, বেনের ছেলে হল। ছেলের নাম হল জয়দেব, মেযের নাম হল জয়াবতী। দুজন দিনে দিনে বড় হতে লাগলো। জয়াবতী ফুল তুলে, পূজা করে, মঙ্গলবার করে – কথা শোনে। একদিন জয়দেব বললে মা! আমি জয়াবতীকে বিবাহ করবো। মা বললেন, ‘সে কি বাবা! তুমি গরিব ছেলে – বড় মানুষের মেয়ে তোমার সঙ্গে বিয়ে দেবে কেনো? তারপর মা মঙ্গলচণ্ডী অন্তর্ধান হলেন।
সওদাগরের ভয়ে আকুল হয়ে, সেই পাত্রের সাথে জযাবতীর বিয়ে দিলেন। সোনা, দানা,বাউটি দিয়ে, হাওদা বেঁধে বর কনে পাঠিয়ে দিলেন।পথে যেতে যেতে জয়াবতীর মনে পড়ল আজ মঙ্গলবার। তখন জয়াবতী গুনগুন করে কথা বলতে লাগল।
জয়দেব বললো..’ও কি জয়াবতী? কি গুনগুন করছো, বিড় বিড় করে বকছো কেন?”,
জয়াবতী বললে – ‘গুনগুন কিছুই করিনি, আজ মঙ্গলবার, তাই মা মঙ্গলচন্ডীর কথা শুনছি।’ জয়দেব বললো – ‘মঙ্গলবার করলে কি হয়?’, জয়াবতী – ‘হারালে পায়, স্বামী পুত্র জলে ডোবে না, আগুনে পোড়ে না, মরলে বাঁচে।’ খানিক পথ গিয়ে জয়দেব বললো, ‘জয়াবতী! এখানে বড় ডাকাতের ভয়! ওই যে নদী দেখছ, ওইখান থেকে ডাকাতেরা এসে সব লুটপাট করে নিয়ে যায়, তোমার গায়ের সব গয়না আমায় খুলে দাও।’ জয়দেব গয়না খুলে নিয়ে একটা পুঁটলি করে ঝপাং করে জলে ফেলে দিলো। জয়াবতী চুপ করে রইল, কিছু বললো না। বর কনে ঘরে গেল। জয়দেবের মা ও সাত বোন বরণ করে বর-কনে কে ঘরে তুলল। পাড়ার সব মেয়ে বউরা দেখতে এলো। যে দেখে সেই নিন্দে করে, বলে ‘ওমা! বড় মানুষের মেয়ে যে গো? গায়ে একটু রাঙরত্তি দেয়নি। একখানি ভালো কাপড় পর্যন্ত দেয়নি।’ বেনেগিন্নি বললো, ‘চুপ করো বোন, কিছু বলো না। আমার যেমন বরাত।’আজ বউভাত হবে, মা মঙ্গলচন্ডী দেশের সব মাছ হরণ করলেন, কোথাও মাছ পাওয়া গেল না। সাত খানা গাঁয়ের বেনে কুটুম্ব খেতে বলা হয়েছে। কী হবে? নদীতে জাল ফেলে একটা প্রকাণ্ড রাঘব বোয়াল পাওয়া গেল। সে মাছ কেউ কুটতে পারলো না। কুড়ুল ভেঙে গেল, তবু মাছ কেউ কুটতে পারলো না। জয়দেব বললো – ‘মা! জয়াবতীকে মাছ কুটতে দাও।’ জয়দেবে মা বললে- ‘তুই কি ক্ষেপেছিস? ও ছেলেমানুষ, ও কি মাছ কুটতে পারে?’, ‘হ্যাঁ পারবে’ বলে জয়দেব বঁটি এগিয়ে দিল।
জয়াবতী ঘোমটা দিয়ে মা মঙ্গলচন্ডীর নাম করে যেমনি মাছটি তুলে বঁটিতে ধরেছে, অমনি মাছটি দুখান হয়ে গেল। মাছের পেটের ভেতর থেকে জয়াবতীর সেই গয়নার পু্ঁটলি বের হয়ে এলো। জয়াবতী মাছ ফেলে রেখে পু্ঁটলিটি নিয়ে ঘরে চলে গেল। কিছুক্ষন পর ভালো কাপড় পড়ে, সাথে হিরে জড়োয়ার গয়না পড়ে, ঝম ঝম করে বাইরে এসে মাছ কুটতে বসলো। সবাই অবাক হয়ে চেয়ে রইল, জয়দেব হাসতে থাকল। তারপর সকলে ভেবে অস্থির, এত লোকের রান্না কে রাঁধবে? জয়দেব বললো – ‘কেন? জয়াবতী রাঁধবে।’ জয়াবতী মাথা নেড়ে স্বীকার করলো.. মা মঙ্গলচন্ডীকে স্মরণ করে রান্নাঘরে যেতেই এক দন্ডের মধ্যে ৫০০ লোকের রান্না হয়ে গেল।
লোকজন সব খেয়ে বলতে লাগলো – ‘এমন খাওয়া আমরা কখনো খাইনি। কী চমৎকার রান্না।’ – বলে ধন্যি ধন্যি করে চলে গেল। কিছুদিন পর জয়াবতীর এক ছেলে হল। নাতির মুখ দেখে জয়াবতীর শ্বশুর-শ্বাশুড়ি স্বর্গে গেলেন।
জয়াবতী ছেলেকে ঘরে ঘুম পাড়িয়ে কাজকর্ম করছে, এমন সময় জয়দেব ছেলেটিকে তুলে নিয়ে কুমোরদের পনের মধ্যে গুঁজে রেখে এলো। তারা যতই পনে আগুন দেয়, ততই নিভে যায়। কুমোরদের গিন্নি গিয়ে দেখে, জয়াবতীর ছেলে পনের ভেতর শুয়ে খেলা করছে। সে তখন তাড়াতাড়ি ছেলেকে নিয়ে জয়াবতীর কাছে দিয়ে এল। আর একদিন জয়দেব ছেলেটিকে নিয়ে নদীর জলে ফেলে দিয়ে এল। জয়াবতী জল আনতে গেলে, ছেলেটিও তার সাথে সাথে উঠে এলো। জয়দেব দেখে আশ্চর্য হল কিন্তু ভ্রম গেল না। তারপর জয়াবতীর আর একটি ছেকে ও একটি মেয়ে হল। একদিন জয়াবতীর ছোট ছেলেটি দোতলায় শুয়ে আছে, ছেলে মেয়ে দুটি সেখানে খেলা করছে। জয়দেব একখান কাত্যান নিয়ে ছোট ছেলেটির গলায় কোপ মারছে কিন্তু ছেলে কাটা যাচ্ছে না। জয়াবতী তাড়াতাড়ি জয়দেবের হাত ধরে বললো, ‘একি তুমি কি করছো? এতবার এত পরীক্ষা করলে, তবুও বিশ্বাস হল না? আমি তো বলছি যে, মা মঙ্গলচন্ডীর কৃপায় আমার কোন অমঙ্গল ঘটবে না।’ তখন জয়দেব বললো – ‘তুমি যখন এমন ব্রত জানো, তাহলে আমরা মর্ত্যে থাকি কেন, চলো স্বর্গে যাই।’ জয়াবতী বললে – ‘আগে ছেলে মেয়ের বিয়ে হোক, বউমা হোক, জামাই হোক, তারপর স্বর্গে যাব।’
দিন কতক পরে জয়াবতীর ছেলে মেয়ের বিয়ে হল। মনের সুখে দিন কতক সংসার করে, জয়াবতী বউ-ঝিয়েদের ঘরকন্না বুঝিয়ে দিলে। স্বর্গ থেকে পুষ্পক রথ নেমে এল, চুয়া চন্দনের ছড়া পড়তে লাগলো। বউ ঝিয়ে দের জয় মঙ্গলবারের ব্রত করতে বলে, জয়দেব ও জয়াবতী স্বর্গে চলে গেল। সেই অবধি জয় মঙ্গলবার পৃথিবীতে প্রচার হল।মঙ্গলচণ্ডী ব্রতঃদেবী অপ্রাকৃত মহিমার প্রশস্তিগীতি ব্রতের ছড়ায় এসে ধরা দেয়।যথা —সোনার মা ঘট বামনী।রূপোর মা মঙ্গলচণ্ডী।।এতক্ষণ গিয়েছিলেন নাকাহার বাড়ি?হাসতে খেলতে তেল সিন্দুর মাখতেপাটের শাড়ি পরতে সোনার দোলায় দুলতেহয়েছে এত দেরী।নির্ধনের ধন দিতেকানায় নয়ন দিতেনিপুত্রের পুত্র দিতেখোঁড়ায় চলতে দিতেহয়েছে এত দেরী।
”মঙ্গলচণ্ডীর পুজোয় এখনও মেয়েরা আওড়ায় এই মন্ত্র ,“আটকাটি,আটমুঠি সোনার মঙ্গলচণ্ডী রুপোর পা,কেন মাগো মঙ্গলচণ্ডী হল এত বেলা?হাসতে খেলতে ,তেলহলুদ মাখতে ,আঘাটায় ঘাট করতে ,আইবুড়োর বিয়ে দিতে ,অন্ধের চক্ষু দিতে ,বোবার বোল ফোটাতে,ঘরের ঝি বৌ রাখতে ঢাকতে হল এত বেলা৷”
– এ ভাবেই সংসারের রমণীটি সংসারের সার্বিক সুখ শান্তি কামনা করে থাকে৷ আর একটা কারণ হল, গ্রীষ্মের দাবদাহে ফুটিফাটা বাংলার মাঠঘাট৷ মা চণ্ডীর পুজোয় যদি সময়মতো বর্ষা নামে, সেই আশায় মা চণ্ডীর শরণাপন্ন হওয়া৷ অভীষ্ট সিদ্ধিমানসে হিন্দু মহিলা মঙ্গলবারে মঙ্গলচণ্ডী দেবীর অর্চনা ও ব্রত উপসাবাদি করে থাকেন। ধনপতি সওদাগরের পত্নী খুল্লনা প্রথম মঙ্গলচণ্ডীদেবীর পূজার প্রবর্তন করেন। এই খুল্লনার নামানুসারেই বাংলাদেশের ‘খুলনা’ জেলার নামকরণ হয়েছে বলে জনশ্রুতি। দেবীর করুণাশক্তি অমোঘ। তাঁর শরণাগত হলে নির্ধন ধনী হয়, অন্ধ নয়ন পায়, বন্ধ্যা পুত্র লাভ করে, খঞ্জ চরণযুক্ত হয়। সংসারজীবনে এই মঙ্গলময়ীর আরাধনা তাই একান্তই প্রয়োজন। কুমারীজীবন থেকেই তারা আরাধনা শুরু করে এবং সমগ্র জীবনব্যাপী তা চলতে থাকে।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ আশুতোষ বন্ধ্যোপাধ্যায়, শুভ্র ভট্টাচার্য।