ঐতিহ্যের সফর: কামাখ্যা মন্দির ,তন্ত্রসাধকদের গোপনাচারের এক রহস্যময় তীর্থ…..
মন্দিরের নামকরণ
আসামের কামরূপ জেলার গুয়াহাটি শহরের পশ্চিমে নীলকন্ঠ পাহাড়ের চূড়ায় এক প্রাচীন মন্দির কামাক্ষা দেবীর মন্দির নামে পরিচিত। গুয়াহাটি স্টেশন থেকে পাহাড়ি রাস্তায় কামাক্ষা মন্দির। এটি ৫১ সতীপীঠের অন্যতম। প্রাচীন কাল এই অঞ্চলটির নামছিল প্রাগজ্যোতিষপুর, এখানকার রাজা ছিলেন শক্তিশালী নরকাসুর। কথিত আছে মদন ভস্মের পর, বিদেহী কামদেব এখানে দেবী মহাশক্তির আরাধনা করে পুনরায় নিজের রূপ ফিরে পান, সেই থেকে এখানকার নাম কামরূপ।
দশমহাবিদ্যার মন্দির
কালী, তারা ,ভুবনেশ্বরী, বগলামুখী, ছিন্নমস্তা, ত্রিপুরাসুন্দরী, ভৈরবী, ধূমাবতী, মাতঙ্গী ও কমলা – এই দশ দেবীরূপের মন্দির রয়েছে। এর মধ্যে ত্রিপুরাসুন্দরী, মাতঙ্গী ও কমলার পুজো প্রধান মন্দিরে এবং অন্যান্য দেবীদের পৃথক মন্দিরে পুজো করা হয়। তন্ত্রসাধকদের কাছে এই মন্দির একটি পবিত্র তীর্থ।প্রাচীনকালে কামাখ্যা ছিল খাসিউপজাতির বলিদানের জায়গা। এখানে অনেক ভক্তই দেবীর উদ্দেশ্যে ছাগল বলি দেন।
মন্দিরের ধংসের কারণ
মোঙ্গলদের আক্রমণ কালে ১২ খ্রীষ্টাব্দে প্রথম কামাখ্যা মন্দিরটি ধ্বংস হয়েছিল। দ্বিতীয় মন্দিরটি ধ্বংস হয়েছিল মুসলমানি আক্রমণের সময়।
দেবীর বিভিন্ন নামে পূজা
দেবীকে যেসব নামে পূজা করা হয় তার মধ্যে অনেক স্থানীয় আর্য ও অনার্য দেবদেবীর নাম আছে। যোগিনী তন্ত্রমতানুসারে অনুসারে, এই যোগিনী পীঠের ধর্মের উৎস কিরাতদের ধর্ম। গারো উপজাতির মানুষেরা কামাখ্যায় শূকর বলি দিত। দক্ষিণাচার ও বামাচার মতে সাধারণত ফুল দিয়েই দেবীর পূজা দেওয়া হয়। মাঝে মাঝে পশুবলি হয়। স্ত্রীপশু বলি নিষিদ্ধ হলেও, বহু পশুবলির ক্ষেত্রে এই নিয়মে ছাড় দেওয়া হয়।
ভারতীয় ইতিহাসের পাতায় কামাখ্যার উল্লেখ
প্রাচীনকালে কামরূপ রাজ্যের বর্মণ রাজবংশের শাসনকালে এবং সপ্তম শতাব্দীতে হিউয়েন সাং-এর রচনাতে কামাখ্যা উপেক্ষিত হয়েছে। সেই সময় কামাখ্যাকে কিরাত জাতীয় উপাস্য দেবী হিসাবে মনে করা হত। নবম শতাব্দীতে বানমলবর্মদেবের তেজপুর লিপিতে প্রথম কামাখ্যার উল্লেখ পাওয়া যায়। এই লিপি থেকে জানা যায়, খ্রিস্টীয় অষ্টম-নবম শতাব্দীতে এখানে একটি বিশাল মন্দির ছিল। লোকশ্রুতি, সুলেমান কিরানির সেনাপতি কালাপাহাড় এই মন্দির ধ্বংস করেছিলেন। তবে ঐতিহাসিক প্রমাণ থেকে জানা যায়, আলাউদ্দিন হুসেন শাহ কামতা রাজ্য আক্রমণ করার সময় এই মন্দির ধ্বংস হয়েছিল। কথিত আছে, কোচ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বসিংহ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ খুজে পান। এবং তিনিই এই মন্দিরে আবার পূজা শুরু করেন। তাঁর পুত্র নরনারায়ণের রাজত্বকালে এই মন্দিরটির নির্মাণকার্য শেষ হয়। পরে অহোম রাজ্যের রাজারা এই মন্দিরটি আরও বড়ো করে তোলেন এবং অন্যান্য মন্দিরগুলি পরে নির্মিত হয়।
বাৎস্যায়নের মতে, পূর্ব হিমালয়ের গারো পাহাড়ে তারা দেবীর তান্ত্রিক পূজা প্রচলিত ছিল যেখানে আদিবাসীরা দেবীর যোনিকে ‘কামাকি’ নামে পূজা করত। কামাখ্যা কালিকাপুরাণ অনুযায়ী মহাশক্তির অংশ হিসেবে পূজিত হন।যোগিনী তন্ত্রে কালিকা পুরাণের মতকে গ্রাহ্য করে কামাখ্যাকে কালী বলা হয়েছে এবং যোনির প্রতীকতত্ত্বের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।মন্দিরের ভেতরে তিনটি প্রকোষ্ঠ। সবচেয়ে বড় পশ্চিম প্রকোষ্ঠটি আয়তাকার যেখানে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। মাঝের কক্ষটি বর্গাকার যেখানে দেবী কামাখ্যার মূর্তি আছে। দেওয়াল জুড়ে শিলালিপি, মহারাজ নরনারায়ণএবং অন্য হিন্দু দেবতার মূর্তি দেখা যায়। এই প্রকোষ্ঠর পরেই গুহা সংবলিত গর্ভগৃহ শুরু হয়েছে। গুহার দেওয়ালে কোনও ছবি নেই। সরু সিঁড়ির ধাপের শেষে যোনি আকৃতির পাথরের ফাটল থেকে ঝরে পড়ছে প্রাকৃতিক ঝরণাধারা। জলের ধারা সৃষ্ট একরত্তি জলাশয়ের ধারায় অবিরাম পূজার্চনা চলে। ধারার উৎসমুখ ঢাকা থাকে এক টুকরো লাল কাপড়ে।
কথিত, কোচবিহারের রাজবংশের কেউ নীলাচল পর্বতের পাশ দিয়ে গেলে মন্দিরের দিকে তাকান না,কারণ দেবীর বারণ আছে।কামাখ্যার পৌরাণিক বর্ণনা —দক্ষ যজ্ঞে, পিতা দক্ষ সতীকে অবহেলা করেন এবং শিবকে অপমান করে। সেই রাগে যজ্ঞস্থলেই সতী দেহত্যাগ করলেন। শিব সতীর দেহত্যাগের কথা জেনে সেখানে হাজির হলেন এবং ক্রোধে পাগল হয়ে সমগ্র যজ্ঞ পন্ড করে দক্ষকে হত্যা করে উমার দেহ কাঁধে প্রলয় করতে শুরু করেন। তখন বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র দ্বারা সতীর দেহ খন্ডিত হয় এবং একান্নটি জায়গায় পরে। তার একটি কামাখ্যা যেখানে দেবীর যোনিদেশ পরেছিল।
কথিত আছে যোনিরূপ যে প্রস্তরখণ্ডে মা কামাক্ষা অবস্থান করছেন, সেই শিলা স্পর্শ করলে মানুষ মুক্তিলাভ করে। কালিকাপুরাণের ছাব্বিশতম অধ্যায়ে কামাক্ষার বর্ণনা রয়েছে। পূর্বে এই পর্বতের উচ্চতা ছিল শতেক যোজন। কিন্তু মহামায়া সতীর যোনি অঙ্গ পতিত হওয়ার পর এই উচ্চ পর্বত মহামায়র যোনি মন্ডলের ভার সহ্যে করতে না পেরে কেঁপে উঠলো এবং ক্রমশঃ পাতালে প্রবেশ করতে লাগলো। তখন শিব, ব্রহ্মা, বিষ্ণু প্রত্যেকে একটা করে শৃঙ্গ ধারন করলেন। তাদের সঙ্গে মহামায়া স্বয়ং সমবেত হলেন। এবং পাতাল প্রবেশ থেকে রক্ষা করলেন এই শৃঙ্গকে। ফলে পর্বতের উচ্চতা একশতো যোজন থেকে এক ক্রোশ উঁচু হয়েগেল। আর মতৃ যোনি পতিত হওয়ার ফলে পর্বতের রং নীল বর্ণ আকার ধারণ করলো। তাই পর্বতের নাম হলো নীলকণ্ঠ পর্বত। অনেকে আবার নীলাচল পর্বতও বলে।যেখানে সতীর যোনি মন্ডল পতিত হয়েছিল সেই জায়গাটাকে বলে কুব্জিকাপীঠ।
তথ্য উৎস: দেবী পুরাণ, কালিকা পুরাণ, বাৎসায়নের কামসূত্র, কালকূটের শাম্ব, কোচবিহারের ইতিহাস এবং অন্তর্জাল