যেই গৌর, সেই কৃষ্ণ, সেই জগন্নাথ।
ভগবান জগন্নাথদেব হলেন শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং যিনি জগতেরনাথ বা জগদীশ্বর। সংস্কৃতি ভাষায় জগত অর্থে বিশ্বএবং নাথ অর্থে-ঈশ্বর বোঝায়। সুতরাং জগন্নাথশব্দের অর্থ হলো জগতের ঈশ্বর বাজগদীশ্বর।
স্কন্ধ পুরানে রথযাত্রা
স্কন্ধ পুরানে রথযাত্রার মহিমা বর্ননা করে বলাহয়েছে- যিনি গুন্ডিচা মন্দিরে (জগন্নাথের মাসীর বাড়ী) ভগবানের শ্রীবিগ্রহকে দর্শন করারসৌভাগ্য অর্জন করেন, তিনি সহস্র অশ্বমেধযজ্ঞের ফল লাভ করেন।
নাতঃ পরতরং কর্ম হ্যানায়াসেন মোচনম্।
জ্যৈষ্ঠজন্মদিনে স্নানং হর্রেযদবলোকিতম্।
স্কন্দ পুরাণে পুরুষোত্তম ক্ষেত্র মাহাত্ম্যে (৩১.৭৬) উক্ত রয়েছে
জ্যৈষ্ঠী পূর্ণিমায় শ্রী হরির স্নানযাত্রা দর্শনের মাধ্যমে অনায়াসেই জীব মুক্তি লাভ করতে পারে। এমন কি কেউ যদি ভক্তি সহকারে একবারও স্নান যাত্রা মহোৎসব দর্শন করেন, তাঁর সংসার বন্ধন থেকে মুক্তি লাভ সুনিশ্চিত হয়ে যায়। তার আর শোক করতে হয় না। জৈমিনি মুনি স্নান যাত্রার মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ভগবান পুরুষোত্তমের স্নানযাত্রা দর্শন করলে জীব তীর্থ সমূহে় স্নান করার থেকেও শতগুণ অধিক ফল প্রাপ্ত হয় এবং এতে কোনো সংশয় নেই।
(স্কন্দপুরাণ ৩১.৮২) জৈমিনি ঋষি আরোও বর্ণনা করেছেন, যদি কেউ আন্তরিকতার সাথে স্নান কালে ভগবানকে নিরীক্ষণ করে, তাদেরকে আর মাতৃগর্ভে বাস করতে হয় না। উৎসুকতাপূর্ণ হৃদয়ে স্নানযাত্রা দর্শন করলে জীবগণ ভবসাগর থেকে উদ্ধার লাভ করতে পারে। পরম আনন্দ সহকারে স্নানযাত্রা দর্শন করলে মানুষ আজন্ম যা পাপ করেছে তা বিনষ্ট হয়ে যায়।
স্কন্ধ পুরাণ অনুসারে রাজা ইন্দ্রদুম্ন যখন জগন্নাথদেবের কাঠের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করলেন তখন থেকে এই স্নান যাত্রার উৎসব শুরু। স্নান যাত্রারদিনটিকে জগন্নাথ দেবের আবির্ভাব তিথি বা জন্মদিন হিসেবে পালন করা হয়। স্নান যাত্রার আগের দিন জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা দেবী এবং সুদর্শন দেবকে বেদী থেকে বিশেষ ভাবে তৈরি করা স্নান বেদীতে নিয়ে আসা হয়। পুরীর মন্দিরপ্রাঙ্গনে বিশেষ ভাবে তৈরি করা এই মণ্ডপকে বলাহয় স্নান মণ্ডপ। এটা এত উঁচু যে মন্দির প্রাঙ্গনেরবাইরে থেকেও বেদিতে উপবিষ্ট বিগ্রহ সমূহঅবলোকন করা যায়।অনুষ্ঠানের দিন স্নান মণ্ডপকে ঐতিহ্যবাহী ফুল, বাগান ও গাছের চিত্রকল্প দ্বারা সজ্জিত করা হয়।
তোরণ এবং পতাকা দ্বারা সজ্জিত করা হয়।জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা দেবীর বিগ্রহ ফুল দিয়েসাজানো হয়। এর পর বিগ্রহের উদ্দশ্যে ধুপ, ধুনাঅর্পণ করা হয়।জগন্নাথের স্নানযাত্রার পর মন্দির পনরো দিন পর্যন্ত বন্ধ থাকে।
জগন্নাথের জ্বর হয়। পনরো দিন পর মন্দির খোলা হয়। নয়নকল উৎসবে নয়ন খুলবে। জগন্নাথকে সাজানো হয়। শ্রীক্ষেত্র পুরী হল মর্ত্যের বৈকুন্ঠ, দ্বারকা। পুরী মন্দিরের চারটা দরজা। অশ্ব,হস্তি, ব্যাঘ্র, সিংহ। অশ্ব-অর্থ, হস্তি-মোক্ষ,ব্যাঘ্র-কাম, সিংহ-ধর্ম। জগন্নাথ সিংহ দরজা দিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করে। মহাপ্রভুও এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতেন জগন্নাথ দর্শনে। হস্তি দরজা দিয়ে জগন্নাথ বের হয় সমাধিতে যাওয়ার জন্য। দরজা বন্ধ থাকে সবসময়। শুধু জগন্নাথ সমাধিতে যায় এই দরজা দিয়ে।
স্নান যাত্রার মূল তত্ত্ব
একবার দেবকী, বাসুদেবের বাসনা হল তীর্থ স্নান করবে। বলরাম কৃষ্ণ বললেন দেবকী বাসুদেবকে। কুরুক্ষেত্রে অমাবস্যায় সূর্যগ্রহনের স্নান করলে মোক্ষ লাভ হয়। কুরুক্ষেত্রে একুশবার ক্ষত্রিয়দের বিনাশ করেছিল। তাদের রক্ত থেকে এই সরোবর। আবার পরশুরাম ওখানে তর্পন করে ঐ ক্ষত্রিয়দের। ঐ সরোবর পূর্ণ তীর্থে পরিনত হয়।ঐ খানে সবাইকে নিয়ে আসেছেন দ্বারকাদীশ শ্রীকৃষ্ণ। মা দেবকী, বাসুদেব, সঙ্গে সুভদ্রা মাতা, কৃষ্ণের আট জন মহাপটরানী, সঙ্গে বলরাম তার সাথে বারূণী, রেবতী যাচ্ছেন। অনেক সৈন্য, অনেক বাদ্যযন্ত্র বাজছে।
নারদজী ভাবছেন, শ্রীকৃষ্ণ আসেছেন কুরুক্ষেত্রে এই কথা ব্রজবাসীদের বলতে হবে। নারদজী বীনায় কৃষ্ণ নাম করতে করতে চললেন ব্রজে। একমাসের বেশীসময় কৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রে থাকবে এই খবর দিতে চললেন নারদজী ব্রজে। ব্রজে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে অঙ্গে জ্বলতে লাগল। যোগ ধ্যানে বসলেন নারদজী কেন তার অঙ্গ জ্বলছে। বিরহ তাপে অঙ্গ জ্বলছে ব্রজধামের, যমুনার, স্থাবর-জঙ্গম, গোবৎস, গাভী, গোপ গোপী, মা যশোদা নন্দবাবা। কৃষ্ণবিরহে সবাই কাঁদছে। নারদজী দেখলেন ব্রজে নন্দালয়ে যশোদা ননী নিয়ে গোপাল গোপাল করে কাঁদছে। শ্রীদাম পটে আঁকা কৃষ্ণের ছবি দেখে কেঁদে কেঁদে বলছে, কানাইয়া দেখ মিষ্টি ফল আনেছি। এটো ফল দিই নি রে। এটো ফল দিলাম বলে তুই আমাকে ছেড়ে চলে গেলি এই বলে কাঁদতে লাগল।
এদিকে রাধা কাঁদে সখীদের গলা ধরে। নারদজী বললেন তোমাদের নয়নাভিরাম কুরুক্ষেত্রে। চল তোমরা দর্শন করবে তোমাদের প্রাণ গোবিন্দকে। রাধাকে বলল ললিতা চল সখী তোকে সাজিয়ে দিই।রাধারাণী বলল আমি সেজে বসে আছি। নয়ন সেজেছে শ্যামের রূপ দর্শনে, হাত সেজেছে শ্যামের পদসেবনে,কানের ভূষন আমার শ্যামের নাম শ্রবন।সবাই চল কুরুক্ষেত্রে। বিরহিনী গোপীরা এক কুঞ্জে শ্যাম আছে শুনে দর্শনে ব্যাকুলতা নিয়ে গেল। দেখল যে বনমালী, যে গোপালকে ওরা ভালবাসত সে কৃষ্ণ নয়। কোথায় বনমালা কোথায় চুড়া। এ রাজার বেশে কৃষ্ণকে ভালবাসে না ওরা। দেখা না করে চলল রাধা। যোগমায়া দেখলেন রাধারানী কৃষ্ণ দর্শন না করে চলে যাচ্ছেন। কৃষ্ণকে বলল রাধারানী চলে গেছে শুনে শ্যামের মনে বিরহ হল রাধা বিরহ। এদিকে যোগমায়া অপূর্ব কুঞ্জ রচনা করলেন রাধা আর প্রিয় সখীদের জন্য। কৃষ্ণ আসবেন রাধার সেই অপূর্ব কুঞ্জে। কিন্তু এর জন্য রুক্মণীকে মানে লক্ষীকে রাজি করাতে হবে। রুক্মনী তো রাজি হয় না কিছু তো। কিছুতে যেতে দেবে না তাকে। এই নিয়ে দুইজনের রাগ। তাইতো রাগ করে লক্ষী রান্না করে না। তখন কৃষ্ণ বলে আমার দাদা বলরাম কি দোষ করল, ও কেন না খেয়ে থাকবে। তাই শুধু পাচন রান্না করেন।
কুরুক্ষেত্রে এই স্নান এল জগন্নাথের স্নান যাত্রা। এই যোগমায়ার কুঞ্জ হল গন্ডিচা মন্দির। যা যোগমায়া তৈরি করলেন।
জগন্নাথের জ্বর হল রাধার বিরহ জ্বর হল। জগন্নাথ যাবে রথে করে ভক্ত দর্শনে। রাধার কুঞ্জে গন্ডিচা মন্দিরে যাবে রথে করে। কিন্তু লক্ষী যেতে দেবে না। জগন্নাথের সাথে বলরাম সঙ্গে সুভ্দ্রা তাতে রাজি হলেন মা লক্ষী। তাই রথে আগে বলরাম, পরে সুভদ্রা তারপর জগন্নাথ।
পুরীতে জগন্নাথ স্নান
জয় জগ্ননাথ……পুরীতে স্নানের জন্য সোনার তৈরি এক ধরনেরকুয়া থেকে জল আনা হয়। জল আনার সময়পুরোহিতরা তাদের মুখ কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখেনযাতে জল তাদের মুখনিঃসৃত কোন কিছু দ্বারা এমনকি তাদের নিঃশ্বাস দ্বারা দূষিত না হয়।
স্নান মহোৎসবের পূর্বে জগন্নাথ,বলরাম এবংসুভদ্রা দেবীকে সিল্কের কাপড় দ্বারা আবৃত করাহয় এবং তারপর লাল এক ধরনের পাউডার দিয়েপ্রলেপ দেওয়া হয়। ১০৮ টি স্বর্ণ পাত্র জল দ্বারাপূর্ণ থাকে। এই জল দ্বারা অভিষেক করা হয়। অভিষেকের সময় বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ,কীর্তন এবংশঙ্খ বাজানো হয়।এরপর জগন্নাথ দেব এবং বলরাম দেবকে হাতিবেশে সাজানো হয়। এই সময় সুভদ্রা দেবীকেপদ্ম নতুন সাজে সাজানো হয়। স্নান যাত্রা উৎসবের পর স্নান পূর্ণিমা থেকে আষাড়ী অমাবস্যা পর্যন্ত১৫ দিন ভগবানকে জনসাধারণ থেকে দূরে রাখা হয়।এই ১৫ দিন মন্দিরে । এই ১৫ দিনে ভগবানের নিত্য পূজা পাঠ চালু থাকে এবং তার সাথে সাথে এই অনবসর সময়ে ভগবান জগন্নাথ দর্শন করার জন্য জগন্নাথ মন্দিরের সিংহদ্বারের ঠিক ডান দিকে জগন্নাথ পট্ট দর্শন করা হয়সময় ভগবান জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রা দেবীকেরতন বেদী নামে এক বিশেষ বেদীতে রাখাহয়। যেহোতু স্নান করানোর ফলেবিগ্রহ সমূহ বিবর্ণ হয়ে যায়।
এই ১৫ দিনে জগন্নাথদেবকে আগের নব সাজে ফিরিয়ে আনা হয়। ১৬ তমদিনে জগন্নাথ দেবকে আবার সবার দর্শনের জন্যউন্মুক্ত করা হয়।প্রসঙ্গত জগন্নাথ ভগবানের অনঅবসর সময়ে ভগবান তিনি বিশেষ কিছু লীলা করে থাকেন তার প্রধান কারণ হচ্ছে ভগবান তিনি সবার অগোচরে থেকে প্রত্যেকের হৃদয়ে ভগবানের প্রতি প্রেমকে তিনি আরো সমৃদ্ধ করেন বিরহের দ্বারা এবং ভগবান জগন্নাথ তিনি অবসর সময়ে তিনি নব শৃঙ্গারে সুসজ্জিত হনl এই অনবসর সমযে় ভগবান জগন্নাথদেবের অভিন্ন রূপকে দর্শন করার জন্য ভক্তরা ব্রম্হ্যগিরিতে আলালনাথ ভগবানকে দর্শন করতে যান। আলালনাথ অভিন্ন জগন্নাথ এবং আলালনাথ মন্দিরে এই সময়ে প্রচুর ভক্তদের সমাগম হয়।
রথের পনেরো দিন আগে অনরবাহ প্রথায় জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রা হয়।
সাধারণ মানুষ যেভাবে স্নান করেন সেভাবে কি আর দেবতার স্নান হয়? তাই জগন্নাথ দেবের স্নানের জল আসে বদ্ধ কুয়ো থেকে। এমন কুয়ো যেখানে সূর্যের আলো পড়েনি। সেই রকম কুয়ো থেকে গুগন্দি জল দিয়ে প্রস্তুত করা হয় ১০৮ ঘরা জল। এই জলে বিভিন্ন ভেষজ ওষধিও দেওয়া থাকে বলে জানা যায়। তারপর ১০৮ ঘড়া জল দিয়ে দেবদেবীর স্নান সম্পন্ন হয়। কথিত রয়েছে এই জলে স্নান করেই জগন্নাথ দেবের জ্বর আসে। তিনি গৃহবন্দি হন। রথযাত্রা পর্যন্ত বিশ্রাম নেন। আর রথযাত্রার দিন আত্মপ্রকাশ করেন। রাজবেশে সামনে আসেন দেব। অসুখ করলে তাঁর চিকিৎসাও তো করতে হবে নাকি? প্রভু যখন স্নান করেন ‘চাহনি মণ্ডপ’ থেকে তা দেখেন শ্রীলক্ষ্মী মাতা। জ্বরের পর তিনিই নাকি প্রভুর সেবার দায়িত্ব নেন। আর তাঁকে সাহায্য করেন অন্ত্যজ দয়িতাপতিরা। জগন্নাথের সারা শরীরে চন্দন লেপে এই চিকিৎসা করা হয়। সেরে উঠতে সময় লাগে ১৫ দিন। আর এই সময়টা ভক্তদের দর্শন দেন না তিনি। ততদিন জগৎ রক্ষাকারী এই দেবতাকে কম্বল চাপা দিয়ে রাখা হয়।
এদিকে, আজ জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রার সময়ক্ষণের মধ্যে প্রথম পর্ব মঙ্গলপর্ণা। যার সময় রাত ১ টাতেই শুরু হয়েছে। হরিবেশ ১১ টা দেথে শুরু হয়েছে। এরপর বহুদা পাহাড়ি চলবে বিকেল ৫ টা থেকে সন্ধ্যে ৮ টা পর্যন্ত।