ধন’ অর্থাৎ, সম্পদ এবং ‘তেরস’ কথার অর্থ হল তেরো। কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতে দেবী লক্ষ্মী, কুবের এবং ধন্বন্তরীর পুজো উপাসনা করার রীতি। মানা হয়, লক্ষ্মী এবং কুবেরের পুজো করলে ধন লাভ হয়।
পুরাণ অনুযায়ী – সমুদ্র মন্থনের সময় এই তিথিতেই হাতে অমৃত কলশ নিয়ে ধন্বন্তরী প্রকট হন। বিষ্ণু ধন্বন্তরীকে দেবতাদের বৈদ্য ও বনস্পতি এবং ঔষধির অধিপতি নিযুক্ত করেন। তাঁর আশীর্বাদেই সমস্ত বৃক্ষ ও বনস্পতির মধ্যে রোগনাশক শক্তির সঞ্চার হয়।কার্তিক কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতে ধনতেরাস পালিত হয়। এদিন নতুন বাসন, অলঙ্কার, ইত্যাদি কেনা শুভ মনে করা হয়।
কেন পালিত হয় ধনতেরাস –
পুরাণ অনুযায়ী, সমুদ্র মন্থনের সময় এই তিথিতেই হাতে অমৃত কলশ নিয়ে ধন্বন্তরী প্রকট হন। কথিত আছে, ইন্দ্রের অভদ্র আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে মহর্ষি দুর্বাসা তিন লোককে শ্রীহীন হওয়ার অভিশাপ দেন। এর ফলে পৃথিবী থেকে নিজের লোকে গমন করেন অষ্টলক্ষ্মী। জগৎ সংসারে শ্রী প্রতিষ্ঠার জন্য সমুদ্র মন্থনের পরামর্শ দেন শিব। সমুদ্র মন্থনের ফলে ১৪টি প্রমুখ রত্নের উৎপত্তি হয়। চতুর্দশ রত্ন হিসেবে স্বয়ং অমৃত কলশ নিয়ে ধন্বন্তরী প্রকট হন। এর ঠিক দুদিন পর প্রকট হন লক্ষ্মী। তাই ধনতেরাসের দুদিন পর দীপাবলীতে লক্ষ্মী পুজো করা হয়।বিষ্ণু ধন্বন্তরীকে দেবতাদের বৈদ্য ও বনস্পতি এবং ঔষধির অধিপতি নিযুক্ত করেন। তাঁর আশীর্বাদেই সমস্ত বৃক্ষ ও বনস্পতির মধ্যে রোগনাশক শক্তির সঞ্চার হয়।সমুদ্র মন্থনের সময় শরৎ পূর্ণিমায় চাঁদ, কার্তিক দ্বাদশীর দিনে কামধেনু, ত্রয়োদশীর দিনে ধন্বন্তরী ও অমাবস্যার দিনে মহালক্ষ্মীর উৎপত্তি হয়। জনকল্যানের জন্য ধন্বন্তরীই অমৃতময় ঔষধির খোঁজ করেন। তাঁর বংশেই শল্য চিকিৎসার জনক দিবোদাস জন্ম গ্রহণ করেন। মহর্ষি বিশ্বামিত্রের পুত্র সুশ্রুত তাঁর শিষ্য ছিলেন। সুশ্রুতই আয়ুর্বেদের মহানতম গ্রন্থ সুশ্রুত সংহিতার রচনা করেন।স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য ধন্বন্তরীর উপাসনা করা হয়। এদিন ধন- সমৃদ্ধির জন্য কুবেরেরও পুজো করা হয়। পৌরাণিক ধারণা অনুযায়ী, ধনতেরাসের দিনে বিধি মেনে পুজো করলে ও দীপ দান করলে অকাল মৃত্যুর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।ধনতেরাসের সঙ্গে জড়িত পৌরাণিক গল্প:এক সময় বিষ্ণু মৃত্যুলোকে বিচরণ করতে এলে, লক্ষ্মীও তাঁর সঙ্গ নেন। তখন বিষ্ণু বলেন, তাঁর কথা মেনে চললে লক্ষ্মী তাঁর সঙ্গে যেতে পারেন। তাঁর কথা মান্য করে লক্ষ্মী বিষ্ণুর সঙ্গে পৃথিবীতে আসেন।একটি স্থানে এসে বিষ্ণু লক্ষ্মীকে অপেক্ষা করতে বলেন। বলেন, তিনি দক্ষিণ দিকে যাচ্ছেন এবং তাঁর না-আসা পর্যন্ত লক্ষ্মী যেন সেখান থেকে কোথাও না-যান। লক্ষ্মীর মনে দক্ষিণ দিকে বিষ্ণুর গমনের কারণ জানার কৌতূহল জাগ্রিত হয়। এর পর তিনিও বিষ্ণুর পিছু নেন। কিছু দূর এগোনোর পর সরষের খেতে ফুল ফুটে থাকতে দেখে, সেই ফুল দিয়ে লক্ষ্মী শৃঙ্গার করেন ও তার পর ফের অগ্রসর হন। কিছু দূর যাওয়ার পর ইক্ষুর খেত থেকে ইক্ষু তুলে তার রস পান করেন। সে সময় বিষ্ণু সেখানে আসেন ও লক্ষ্মীকে দেখে ক্ষুব্ধ হন। এর পর বিষ্ণু লক্ষ্মীকে অভিশাপ দেন। বলেন, বারণ সত্ত্বেও লক্ষ্মী তাঁর পিছু নেন ও দরিদ্র কৃষকের খেত থেকে চুরির অপরাধ করে বসেন। লক্ষ্মীকে ১২ বছর পর্যন্ত কৃষকের সেবা করতে বলে ক্ষীরসাগরের উদ্দেশে প্রস্থান করেন বিষ্ণু।একবার লক্ষ্মী কৃষকের স্ত্রীকে স্নান করে লক্ষ্মী পুজো ও তার পর রান্না করার কথা বলেন। পুজোর পর কৃষক-পত্নীর সমস্ত মনস্কামনা পূর্ণ হবে বলে জানান লক্ষ্মী। কৃষক-পত্নী তেমনই করেন। ফল স্বরূপ দ্বিতীয় দিনই কৃষকের ঘর অন্ন, রত্ন, ধনে ভরে যায়। এভাবে ১২ বছর পর্যন্ত আনন্দে কাটে কৃষকের সময়। ১২ বছর পর বিষ্ণু লক্ষ্মীকে নিতে এলে কৃষকের স্ত্রী তাঁকে যেতে দেন না। তখন বিষ্ণু জানান, লক্ষ্মীকে কেউ যেতে দিতে চায় না। লক্ষ্মী চঞ্চলা, কোথাও টিকতে পারেন না। তখন লক্ষ্মী ওই কৃষককে জানান, তাঁর কথা মতো চললে, পরিবারে কখনও অর্থাভাব থাকবে না। ধনতেরাসের দিনে ঘর-বাড়ি পরিষ্কার করার কথা বলেন লক্ষ্মী। এর পর রাতে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখে সন্ধাকালে পুজো করতে বলেন। লক্ষ্মী কৃষককে বলেন, একটি রুপোর ঘটে তাঁর জন্য টাকা ভরে রাখতে। তিনি সেই ঘটেই অবস্থান করবেন।
আবার অপর একটি প্রচলিত কাহিনী আছে – রাজা বলির ভয় থেকে দেবতাদের মুক্তি দেওয়ার জন্য বিষ্ণু বামন অবতার নেন। এর পর তিনি বলির যজ্ঞ স্থলে পৌঁছন। কিন্তু সেখানে উপস্থিত অসুরদের গুরু শুক্রাচার্য বামন রূপী বিষ্ণুকে চিনে ফেলেন। রাজা বলিকে শুক্রাচার্য সাবধান করে বলেন যে, বামন রূপে বিষ্ণু সেখানে উপস্থিত হয়েছেন। তাই বামন যা চাইবে, তা যেন দেওয়া না-হয়। কারণ বামন রূপী বিষ্ণু দেবতাদের সহয়াতার জন্য সেখানে প্রকট হয়েছেন। কিন্তু শুক্রাচার্যের কথা অমান্য করে বামন রূপী হরির প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে বামনের তিন পা সমান ভূমি দান করতে রাজি হয়ে যান। শুক্রাচার্য এই দান ভেস্তে দেওয়ার জন্য লঘু রূপ ধারণ করে বিষ্ণুর কমণ্ডলে প্রবেশ করেন। বামনও শুক্রাচার্যের ছল বুঝতে পেরে নিজের হাতে থাকা কুশকে কমণ্ডলে এমন ভাবে প্রবেশ করান, যার ফলে শুক্রাচার্যের একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়।এর পর বলি বামনকে তিন পা সমান জমি ছাড়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। বামন নিজের একটি পা দিয়ে সম্পূর্ণ পৃথিবী ও অপর পা দিয়ে অন্তরীক্ষ মেপে নেন। কিন্তু তৃতীয় পা রাখার জন্য কোনও স্থান বেঁচে না-থাকার কারণে রাজা বলি নিজের মস্তক বামন রূপী বিষ্ণুর পায়ের তলায় রেখে দেন। এ ভাবে দেবতারা বলির ভয় থেকে মুক্তি পায়। এই জয়ের উৎসব হিসেবে ধনতেরাস পালিত হয়।
ভগবান ধন্বন্তরীর জন্ম –
বিশ্বাস অনুসারে, সমুদ্র মন্থনের সময় কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশীর দিন ভগবান ধন্বন্তরী অমৃতের কলস হাতে নিয়ে আবির্ভূত হন। এটা বিশ্বাস করা হয় যে ভগবান বিষ্ণু মহাবিশ্বে চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রসারের জন্যই ধন্বন্তরীর অবতারে জন্ম নিয়েছিলেন। শাস্ত্র মতে ভগবান ধন্বন্তরী দেবতাদের চিকিৎসক। তার পূজা করলে শরীর রোগমুক্ত হয়।
ধন্বন্তরীর আবির্ভাবের স্মরণে প্রতি বছর কার্তিক কৃষ্ণ ত্রয়োদশীর দিনে ধনতেরাস উৎসব পালিত হয়। একই সময়ে, বলা হয় যে দেবী লক্ষ্মী ভগবান ধন্বন্তরীর জন্মের দুই দিন পরে আবির্ভূত হন, তাই ধনতেরসের দু’দিন পরে দীপাবলি উৎসব উদযাপিত হয়।
ধনতেরাসে কাদের পূজা করা হয় –
ধনতেরাসে ভগবান ধন্বন্তরীর পূজা করা হয়। এই দিনে ভগবান ধন্বন্তরীর জন্ম হয়েছিল। শাস্ত্র অনুসারে, ভগবান ধন্বন্তরী অমৃত মূর্তি নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন। ধনতেরাসে ধন্বন্তরী দেবের পাশাপাশি দেবী লক্ষ্মী ও কুবের দেবেরও পূজা করা হয়।
ভগবান ধন্বন্তরী কে –
ভগবান বিষ্ণু অনেক অবতার গ্রহণ করেছিলেন। তেমনই ভগবান বিষ্ণু ধন্বন্তরীর অবতারে জন্মেছিলেন। বিশ্বাস অনুসারে, ভগবান ধন্বন্তরী দেবতাদের চিকিৎসক। রোগমুক্তির জন্য ভগবান ধন্বন্তরীর পূজা করা হয়।
ধনতেরাসে কেন পাত্র কেনা হয়:-
ভগবান ধন্বন্তরী জন্মের সময় অমৃত কলশ বহন করছিলেন। তাই ধনতেরাসের দিন পাত্র কেনার রীতি রয়েছে। বাসনপত্র ছাড়াও, সোনা এবং রূপার মতো যে কোনও ধাতব জিনিস কেনাও শুভ বলে মনে করা হয়।
ধনতেরাস পুজা পদ্ধতি –
ধনতেরাসের দিন সন্ধ্যায় শুভ সময়ে বাড়ির উত্তর দিকে কুবের ও ধন্বন্তরীকে প্রতিষ্ঠা করুন।পাশাপাশি মা লক্ষ্মী ও গণেশের মূর্তি বা ছবি স্থাপন করুন। তারপর প্রদীপ জ্বালিয়ে যথাযথভাবে পূজা শুরু করুন।তিলক করার পর ফুল, ফল ইত্যাদি দেব দেবীদের অর্পণ করুন।ধনের দেবতা কুবের দেবতাকে সাদা মিষ্টি এবং ধন্বন্তরী দেবকে হলুদ মিষ্টি নিবেদন করুন। পুজার সময় ‘ওম হ্রীম কুবেরায় নমঃ’ এই মন্ত্রটি জপতে থাকুন। ভগবান ধন্বন্তরীকে খুশি করতে এই দিনে ধন্বন্তরী স্তোত্র পাঠ করুন।
আমাদের লেখা কেমন লাগলো অবশ্যই comment box e জানাবেন। ধন্যবাদ