বুদ্ধ পূর্ণিমা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। বৈশাখ মাসের এই পূর্ণিমা দিবসে মহামানব বুদ্ধের জীবনের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল বলে দিনটি ‘বুদ্ধ পূর্ণিমা’ নামে খ্যাত। খ্রিস্টপূর্ব ৬২৩ অব্দের এ দিনে গৌতম বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেন, ৫৮৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দের এ দিনে তিনি সাধনায় সিদ্ধি লাভ করে জগতে বুদ্ধ নামে খ্যাত হন এবং ৫৪৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দের এ দিনে তিনি মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। সিদ্ধার্থের বুদ্ধত্বলাভের মধ্য দিয়েই জগতে বৌদ্ধধর্ম প্রবর্তিত হয়।
অনেকেই বৌদ্ধ ধর্মকে একটি পৃথক ধর্মের মর্যাদা দিতে চান না। তাঁরা এক্ষেত্রে গৌতম বুদ্ধকে ভগবান বিষ্ণুর দশম অবতার রূপে গণ্য করেন এবং সেই অনুসারে বৌদ্ধ ধর্মকে হিন্দু ধর্মেরই একটি শাখা রূপে অভিহিত করে থাকেন। এই প্রসঙ্গে কবি জয়দেবের লেখা দশাবতার স্তোত্র বিশেষ ভাবে উদ্ধৃতযোগ্য। স্তোত্রমালার দশম অংশে তিনি গৌতম বুদ্ধের মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন- নিন্দসি যজ্ঞবিধেরহহ শ্রুতিজাতং সদয়হৃদয়দর্শিতপশুঘাতম্/কেশব ধৃতবুদ্ধশরীর জয় জগদীশ হরে! অর্থাৎ হে কেশব, যখন যজ্ঞে পশুহত্যা দেখে আপনার হৃদয় সদয় হয়ে উঠল, তখন আপনি বুদ্ধশরীরে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়ে যজ্ঞবিধি নিন্দা তুলে ধরলেন, আপনার জয় হোক!
গৌতম বুদ্ধ সত্যিই বিষ্ণুর অবতার কি না, সেই বিতর্ক আপাতত থাক! বৌদ্ধ ধর্মের দাপট খর্ব করার জন্য তাকে হিন্দুশাখায় এবং তার পরমপুরুষকে বিষ্ণু-অবতারের শ্রেণীতে স্থান দেওয়া নিয়ে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের কূটনীতিও আপাতত তফাত যাক! আমরা শুধুমাত্র দৃষ্টি ন্যস্ত করি এক অসাধারণ প্রজ্ঞাবান ঐতিহাসিক পুরুষের জীবনধারায়। কেন না, বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের পূর্ণিমা তিথি পঞ্জিকা অনুসারে যা ২৬ মে বুধবার পড়েছে, সেই তিথিতেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। রাজকুলে জন্ম নিয়েও কেন তিনি সন্ন্যাস নিলেন আর কী ভাবে জগতের দুঃখ নিবারণের পথপ্রদর্শন করলেন, বৈশাখী পূর্ণিমা বা বুদ্ধ পূর্ণিমা বা বেসাকের সূত্রে তা এবার জেনে নেওয়া যাক!
বলা হয় যে যিশু খ্রিস্টের জন্মেরও ৫৩৭ বছর পূর্বে নেপালের তরাই অঞ্চলে কপিলাবস্তু নগরে রাজা শুদ্ধোদনের গৃহে জন্ম নিয়েছিলেন তিনি। জন্মগত সুলক্ষণ বিচার করে গণকেরা রাজকুমারের নাম রাখেন সিদ্ধার্থ, অর্থাৎ যিনি কি না জীবনের সর্বপ্রকার অর্থ অর্জন করবেন। সেই সময়েই ঋষি অসিত জানিয়েছিলেন যে শুদ্ধোদনের এই পুত্র ভবিষ্যতে হয় রাজচক্রবর্তী হবে, নয় তো সন্ন্যাসী হবে, কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই সারা বিশ্ব জয় করবে সে! একমাত্র সন্তান যাতে সন্ন্যাস না নেয়, সেই ভয়ে শুদ্ধোদন তাকে মানুষ করতে লাগলেন এক প্রাচীরঘেরা প্রাসাদে।
বলা হয়, কুমার সিদ্ধার্থ একে একে পথভ্রমণে বেরিয়ে এক বৃদ্ধ, এক অসুস্থ, এক মৃত এবং এক সন্ন্যাসীকে দেখেছিলেন। সারথি বলেছিলেন যে জরা, ব্যাধি, মৃত্যু সবাইকেই গ্রাস করে,; সন্ন্যাসী তার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই সাধনায় লীন হন। জগতের স্বরূপ আবিষ্কার করে সিদ্ধার্থের ভোগসুখে বৈরাগ্য আসে, তিনি এক রাতে স্ত্রী যশোধরা এবং সদ্যোজাত সন্তানকে ছেড়ে প্রাসাদ ত্যাগ করেন। এর পর গয়ার কাছে উরুবিল্ব নামে এক স্থানে কঠোর তপস্যা করে যখন তাঁর দেহ ক্ষীণ হয়ে আসে, তখন তিনি বুঝতে পারেন য়ে শরীরকে কষ্ট দিয়ে কোনও দিন মহৎ কিছু অর্জন করা যায় না। এর পর খাদ্যগ্রহণ করে তিনি অশ্বত্থ বৃক্ষতলে একটানা তপস্যায় বসেন এবং বোধি বা সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞান লাভ করেন। এই বোধি অর্জনের সূত্রেই তাঁর নাম হয় বুদ্ধ
বুদ্ধ পূর্ণিমার শোভাযাত্রা
বৌদ্ধ সাহিত্য থেকে জানা যায় যে, পূর্বজন্মে বোধিসত্ত্ব সকল পারমি পূরণ করে সন্তোষকুমার নামে যখন স্বর্গে অবস্থান করছিলেন, তখন দেবগণ তাঁকে জগতের মুক্তি এবং দেবতা ও মানুষের নির্বাণ পথের সন্ধান দানের জন্য মনুষ্যকুলে জন্ম নিতে অনুরোধ করেন। দেবতাদের অনুরোধে বোধিসত্ত্ব সর্বদিক বিবেচনাপূর্বক এক আষাঢ়ী পূর্ণিমায় স্বপ্নযোগে মাতৃকুক্ষিতে প্রতিসন্ধি গ্রহণ করেন এবং পরবর্তী এক শুভ বৈশাখী পূর্ণিমায় জন্মলাভ করেন। তাঁর জন্ম হয়েছিল লুম্বিনী কাননের শালবৃক্ষ ছায়ায় উন্মুক্ত আকাশতলে। তাঁর নিকট জাতি, শ্রেণি ও গোত্রের কোনো ভেদাভেদ ছিল না। তিনি মানুষকে মানুষ এবং প্রাণীকে প্রাণিরূপেই জানতেন এবং সব প্রাণসত্তার মধ্যেই যে কষ্টবোধ আছে তা তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতেন। তাই তিনি বলেছিলেন ‘সবেব সত্তা ভবন্তু সুখীতত্তা’ জগতের সব প্রাণী সুখী হোক। এই মর্মচেতনা জাগ্রত করা এবং এই পরম সত্য জানার জন্য তিনি ২৯ বছর বয়সে সংসার ত্যাগ করেন। সত্যের সন্ধানে পরিভ্রমণ করতে করতে এক সময় তিনি গয়ার উরুবেলায় (বুদ্ধগয়া) গিয়ে নিবিষ্টচিত্তে সাধনামগ্ন হন। দীর্ঘ ছয় বছর অবিরাম সাধনায় তিনি লাভ করেন সম্যক সম্বুদ্ধ বা বুদ্ধত্ব। সেদিনও ছিল বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা তিথি।
বুদ্ধত্ব লাভের পর বুদ্ধদেব জীবের মুক্তি কামনায় ‘ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র’ নামে জীবনের সর্ববিধ ক্লেশ থেকে মুক্তির উপায় আবিষ্কার করেন। তিনি চতুরার্যসত্য নামে খ্যাত এক তত্ত্বে জীবনে দুঃখের উৎপত্তি ও দুঃখভোগের কারণ এবং দুঃখ থেকে মুক্তির পথ নির্দেশ করেন। মুক্তির এই পথনির্দেশনাকে বলা হয় আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ বা আটটি আর্যপথ। দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর তিনি প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল পরিভ্রমণ করে তাঁর এই ধর্মতত্ত্ব প্রচার করেন। রাজা-প্রজা, ধনী-নির্ধন, কুলীন-অন্ত্যজ সর্বশ্রেণীর মানুষের নিকট মুক্তির কথা তুলে ধরে তিনি জগতে এক নতুন ধর্মাদর্শ প্রতিষ্ঠা করেন। আশি বছর বয়সে হিরণ্যবতী নদীর তীরে কুশিনারার মল্লদের শালবনে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগপূর্বক তিনি মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন।এই মহাপরিনির্বাণ লাভের ক্ষণও ছিল বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা তিথি।
বুদ্ধ পূর্ণিমার দিনে বৌদ্ধরা বুদ্ধপূজাসহ পঞ্চশীল, অষ্টশীল, সূত্রপাঠ, সূত্রশ্রবণ, সমবেত প্রার্থনা এবং নানাবিধ মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। তারা বুদ্ধানুস্মৃতি ও সংঘানুস্মৃতি ভাবনা করে। বিবিধ পূজা ও আচার-অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বিবিধ সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়। বৌদ্ধ বিহারগুলিতে বুদ্ধের মহাজীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনাসহ ধর্মীয় সভার আয়োজন করা হয়। শিশু-কিশোরদের মধ্যেও নানা উৎসবমুখর আনুষ্ঠানিকতার ধুম পড়ে যায়। এই পূর্ণিমাকে ঘিরে অনেক বৌদ্ধবিহারে চলে তিনদিনব্যাপী নানামুখী অনুষ্ঠান। বৌদ্ধধর্মীয় পর্ব হিসেবে এ দিনে সাধারণ সরকারি ছুটি থাকে। রেডিও, টেলিভিশনে প্রচার করা হয় বিশেষ অনুষ্ঠান। দৈনিক সংবাদপত্রসমূহে বিশেষ সংখ্যা কিংবা ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়। বিভিন্ন বিহার ও সংগঠন কর্তৃক স্মরণিকা, ম্যাগাজিন ও স্মারকগ্রন্থও প্রকাশ করা হয়। বিভিন্ন গ্রামে ও বিহারে এদিন মেলা বসে। তন্মধ্যে চট্টগ্রামের বৈদ্যপাড়া গ্রামের বোধিদ্রুম মেলা বিখ্যাত।
অষ্টাঙ্গিক মার্গ
ভগবান বুদ্ধ আমাদের পরিচয় করিয়েছিলেন অষ্টাঙ্গিক মার্গের সঙ্গে। এই আটটি নীতি যদি পালন করা যায়, তবে জীবনে কোনও দিন দুঃখ পেতে হয় না। এগুলি হল-
- ১. সম্যক দৃষ্টি বা জীবন সম্পর্কে সৎ ধারণা
- ২. সম্যক সঙ্কল্প বা সৎ জীবনযাত্রা
- ৩. সম্যক বাক্য বা সর্বদা সত্য কথা বলা
- ৪. সম্যক আচরণ বা অন্যকে দুঃখ না দেওয়া
- ৫. সম্যক জীবিকা বা সৎ পথে অর্থোপার্জন
- ৬. সম্যক প্রচেষ্টা বা লোকের ভালো করার প্রয়াস
- ৭. সম্যক স্মৃতি বা সৎ চিন্তা
- ৮. সম্যক সমাধি বা কাজে মনোযোগ