শঙ্খ প্রাচীন শিল্প। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতা আবিষ্কারের সময় শঙ্খশিল্পের বিভিন্ন কারুকাজের নিদর্শন পাওয়া যায়।
শাঁখ বা শঙ্খ শব্দটি এসেছে দুটি সংস্কৃত শব্দ ‘শাম’ ও ‘খাম’ থেকে। ‘শাম’ শব্দের অর্থ শুভ এবং ‘খাম’ শব্দের অর্থ জল। এই শব্দের মিলনে সৃষ্টি হয়েছে ‘শঙ্খম’ শব্দটি। হিন্দু ধর্মে যে কোনও পুজোয় শাঁখ বাজানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। এছাড়া সব শুভ কাজেও শঙ্খধ্বনি অতি জরুরি। প্রতিদিন তুলসীতলায় সন্ধে দিয়ে শাঁখ বাজানোর রীতি রয়েছে।
সাধারণত শঙ্খ পাওয়া যায় ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরে। আরব সাগরেও কিছু প্রাপ্তি ঘটে। প্রাপ্তির ওপর ভিত্তি করে শঙ্খেরবিভিন্ন নামকরণ করা হয়। বিভিন্ন জাতের শঙ্খ রয়েছে। এদের মধ্যে উন্নতমানের হচ্ছে কন্যা কুমারী, রামেশ্বরী, কেপি, জাজি, পাটি, মতি সালামত, ওমেনি, দোয়ালি, সারভি কি, তিতকুটি, ধলা ইত্যাদি। ‘মতি সালামত’ সর্বশ্রেষ্ঠ। কারণ এর মধ্যে মুক্তা পাওয়া যায়। শঙ্খের মুখ, লেজ ও পিঠ আছে। সাধারণত বাম দিকে শঙ্খের মুখ থাকে। যদি শঙ্খের মুখ ডান দিকে থাকে তবে তার মূল্য অনেক। এটাকে নারায়ণের হাতের শঙ্খেরঅনুরূপ মনে করা হয়। এ দক্ষিণমুখী শঙ্খকে সৌভাগ্যের লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ শঙ্খ দিয়ে পূজা করলে ঘরে সৌভাগ্য আসে, বিপদ-আপদ দূর হয়।
হিন্দু সংস্কৃতির সঙ্গে শঙ্খের যোগ আজকের নয়। সেই কোন প্রাচীন কাল থেকে পুজো-অর্চনার কাজে লেগে আসছে এই প্রাকৃতিক উপাদানটি। দুর্গাপূজার অন্যতম অনুষঙ্গ শঙ্খ। পুরোহিতের মন্ত্র, ঢাকের আওয়াজ, শঙ্খধ্বনি এই শব্দগুলো সনাতন পূজা ম-পের পরিচিত অনুষঙ্গ। এগুলো ছাড়া পূজাই হয় না।
শঙ্খ প্রতিটা হিন্দু বাঙালি বাড়িতে থাকে, প্রতিটা বাঙালি বাড়িতে সকাল ও সন্ধ্যায় শঙ্খ বাজানো একটা রীতি।
শঙ্খ তিনবার বাজানো হয় কেন?
হিন্দু সংস্কৃতির সঙ্গে শঙ্খের যোগ আজকের নয়। সেই কোন প্রাচীন কাল থেকে পুজো-অর্চনার কাজে লেগে আসছে এই প্রাকৃতিক উপাদানটি। শাস্ত্র মতে নিত্য পুজোর পরে যদি নিয়ম করে তিনবার শঙ্খ বাজানো যায়, তাহলে গৃহস্থের অন্দরে অশুভ শক্তির প্রভাব কমতে থাকে এবং শুভ শক্তির মাত্রা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। ফলে কোনও খারাপ ঘটনা ঘটার আশঙ্কা যেমন কমে, তেমনি ভাগ্যও ফিরে যায়। ফলে জীবন সুখ -শান্তিতে এবং আনন্দে ভরে উঠতে সময় লাগে না।
শাস্ত্রমত: শাস্ত্রে বলা হয় বাড়িতে শঙ্খ তিনবার বাজানো উচিত। তিনবারের বেশি শঙ্খ বাজানো উচিত নয়। এর কারণ হিসেবে শাস্ত্রে বলা হয় যে, ৩ বার শঙ্খ বাজালে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ এই তিন দেবতার সাথে সমস্ত দেবদেবীরা আমন্ত্রিত হন। কিন্তু তিনবারের বেশি শঙ্খ বাজালে দেবের সাথে দানব বা অসুরকে নিমন্ত্রণ পাঠানো হয়।
হিন্দু ধর্ম শাস্ত্রে বলা হচ্ছে যে, সমুদ্র মন্থনের সময় অসুররা চারবার শঙ্খধ্বনি করে “বলি অসুর” কে নিমন্ত্রণ পাঠিয়ে জাগ্ৰত করেছিল। তাই, তিনবারের বেশি শঙ্খ বাজালে সৃষ্টি, স্থিতি ও বিনাশের দেবতা মহাদেব, বিষ্ণু, ব্রহ্মার পাশাপাশি আসুরি শক্তিও নিমন্ত্রণ পেয়ে আপনার গৃহে প্রবেশ করে। দেবতার পাশাপাশি অসুরকে নিমন্ত্রণের ফল স্বরূপ আপনার ও আপনার পরিবারের উপর নেমে আসতে পারে এইসব দেবতাদের অভিশাপ। তাই শাস্ত্রে তিনবার করেই শঙ্খ বাজানোর পরামর্শ দেওয়া হয়।
হিন্দু পুরাণ ও ধর্মমতে শঙ্খের স্থান
পবিত্র সনাতন ধর্মে শঙ্খ ভগবান বিষ্ণুর প্রতীক। একে বিষ্ণুর অর্ধাঙ্গী হিসেবেও পূজো করা হয়। সৃষ্টির শুরুতে সমুদ্রগর্ভ হতে, পালনকর্তা ভগবান বিষ্ণু ও স্বর্গীয় দেবতাদের তৈরী ঘূর্ণাবর্তের মধ্য থেকে অস্ত্ররূপে শঙ্খকে হাতে ধরে আবির্ভাব হয় ভগবান বিষ্ণুর। অপরদিকে শঙ্খ ধন ও প্রতিপত্তির দেবী মা লক্ষীর আব্রু। “ব্রহ্ম বৈবর্ত পুরাণ” মতে, শঙ্খ ভগবান বিষ্ণু এবং মা লক্ষ্মীর অধিষ্ঠানকারী মন্দির।
পূজো-অর্চনায় শঙ্খের ব্যবহার
আরতিতে দুই ধরণের শঙ্খ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। একটি পূজোর পূর্বে শঙ্খনাদ ধ্বনি উচ্চারনে আর অন্যটি পূজোর সামগ্রী হিসেবে প্রনিত্য পূজো, প্রয়োজন হয়। কিন্তু কখনোই পূজোর আগে বাজানোর জন্যে ব্যবহৃত শঙ্খ পূজোর কাজে ব্যবহার করা উচিৎ নয়। “বরাহ পুরাণ” স্পষ্ট ভাবে বলেছে, কখনই মন্দিরের দ্বার শঙ্খ ধ্বনির উচ্চারণ ব্যতীত খোলা উচিৎ নয়। বামাবর্তী শঙ্খ বাজানোর জন্যে ব্যবহৃত হয়। যেহেতু শঙ্খনী জাতীয় শঙ্খ ব্যবহার নিষিদ্ধ, তাই এগুলো কালো জাদু, যাকে বলা হয় “অঘোরী বিদ্যা” কিম্বা অপদেবতার আরাধনায় কাজে লাগানো হয়।
শঙ্খ ব্যবহারে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
- যে শঙ্খ ব্যবহার করা হয়, সেটা কখনোই পূজোর শঙ্খ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।
- শঙ্খ বাজাবার পর সেটা ধুয়ে রাখা জল কখনোই দেব-দেবীকে অঞ্জলী দেয়া চলবে না।
- কখনোই পূজোর কাজ ছাড়া বাজানোর কাজে শঙ্খটি রাখা যাবে না।
- কোনোক্ষেত্রেই শিব পিন্ডিকে নিত্যপূজো চলাকালীন শঙ্খ দিয়ে স্পর্শ করা যাবে না।
- দেবাদিদেব মহাদেব এবং সূর্যদেবের স্নানের কাজে কখনোই শঙ্খ ব্যবহার করা যাবে না।
শঙ্খের ধর্মীয় এবং বৈজ্ঞানিক উপকারিতা
- শঙ্খকে ওম ধ্বনির উৎপাদক বলা হয়।
- শঙ্খধ্বনি যতদূর পর্যন্ত যায় ততদূর পর্যন্ত লক্ষ্মী দেবী অবস্থান করেন। শঙ্খ কূটরস পুষ্টিবর্ধক, বলকারক। শূলকফ-শ্বাস-বিষ দোষনাশক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। মুখের যে কোনো দাগ মোচন করে শঙ্খ চুন।
- শাঁখ বাজাতে গেলে আমাদের শ্বাস প্রশ্বাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। শাঁখ থেকে ওম শব্দটি নির্গত হয়। সৃষ্টিরও আগে থেকে এই ওম শব্দটির অস্তিত্ব রয়েছে বলে মনে করা হয়।
- শঙ্খ আনে সুনাম, দীর্ঘায়ু আর যশ; দূর করে সকল পাপ, ক্লেশ, উৎপন্ন করে পবিত্র জলের প্রস্রবণ। শঙ্খ ধ্বনি থেকে যে তিন ধরনের শক্তি উৎপন্ন হয় তার চিত্র
- একবার শঙ্খ বাজালে যে ধ্বনি উৎপন্ন হয় তা থেকে তিন ধরণের শক্তি নির্গত হয়। একটি হল “চৈতন্য”। এই শক্তি বৃত্তাকারে শাঁখের খোলোসের মধ্যভাগ হতে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। আরেকটি হল “ধ্যান” যা তির্যক সরলরৈখিক পথে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। আর সর্বশেষ শক্তিটি হল “আনন্দ” যেটা ক্রমান্বয়ে শঙ্খের মধ্যভাগ হতে ধীরে ধীরে সবার অন্তরে ছড়িয়ে পড়ে।
- প্রকৃতিতে প্রধানত তিন ধরণের শক্তি তরঙ্গ থাকে। এই তরঙ্গগুলোই হল সমগ্র সৃষ্টি জগতের নির্মাণ তন্তু। এদের মধ্যে একটি হল “সত্যবাদ তরঙ্গ” আর বাকী দুটি “রাজসিক (অহঙ্কার অর্থে) তরঙ্গ” এবং “তমসিক (দুষ্প্রবৃত্তি) তরঙ্গ”। এই প্রতিটি তরঙ্গের মধ্যে পাঁচ ধরণের মহাজাগতিক উপাদান থাকে। এরা হল “ভূমি”, “জল”, “আগুন”, “বায়ু” এবং “ইথার”। সত্যবাদ, রাজসিক এবং তমসিক তরঙ্গের সংখ্যা এই পাঁচটি উপাদানের ভিত্তিতে যথাক্রমে ১৫০ টি, ২০০ টি এবং ১৫০ টি (সত্যবাদ তরঙ্গের বিপরীত অনুক্রমে বণ্টিত)। রাজসিক আর তামসিক তরঙ্গদ্বয় সত্যবাদ তরঙ্গকে মন্দিরের পরিবেশে প্রবেশে বাধা দেয়। শঙ্খনাদ রাজসিক এবং তামসিক তরঙ্গদ্বয়কে প্রতিহত করে মন্দিরের পরিবেশ, সকল উদ্ভিদ এবং প্রাণীর মাঝে সত্যবাদ শক্তিকে প্রবেশ করায় যা মনের সব অহংবোধ, জড়তা, আঁধার কেটে সবকিছুকে পবিত্র করে। আবার শঙ্খনী জাতীয় শঙ্খে খাঁজগুলো অসম ভাবে বণ্টিত থাকে, যার দরুন এই শঙ্খ বাজালে সত্যবাদ তরঙ্গের ক্ষমতা বিলুপ্ত হয়ে রাজসিক আর তমসিক তরঙ্গের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য কমে গিয়ে কম্পাঙ্ক বেড়ে যায়, অর্থাৎ তীব্রতা বাড়ে।
- “যর্যুবেদ” এবং আধুনিক বিজ্ঞান এর ভাষ্যমতে শঙ্খ থেকে উৎপন্ন কম্পন যে তরঙ্গের সৃষ্টি করে তা বাতাসের সাথে মিশে থাকা জীবাণুকে ধ্বংস করে।
- নিয়ম মাফিক শঙ্খ বাজালে, বাদকের মস্তিষ্কের গোড়ার সুষুম্না কাণ্ড সতেজ থাকে, রক্ত চলাচল বৃদ্ধি পায় এবং রাজসিক ও তমসিক তরঙ্গের অন্তর্গত তেজ ও বায়ুর উপাদানগুলো সাম্যাবস্থায় থাকে।
- আয়ূর্বেদ চিকিৎসা ব্যবস্থায় শঙ্খচূর্ণ একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। শঙ্খ চূর্ণ ক্যালসিয়া, ম্যাগনেসিয়াম এবং লৌহ ধারণ করে যা পেটের পিড়া দূর করে পরিপাক ব্যবস্থাকে সচল রাখে।
- শঙ্খের সাথে আরও কিছু প্রাকৃতিক উপাদানের সমাহারে তৈরী বড়ি “শঙ্খবতী” যা “ডিসপেপসিয়া” নামক অন্ত্রের রোগের চিকিৎসায় ফলদায়ক। এটি বাত, পিত্ত দমন এবং সৌন্দর্য ও শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
- কিছু কিছু শঙ্খ মুক্তা তৈরী করে।
মনে রাখবেন, সনাতন ধর্মের প্রতিটি পূজা-পার্বণ, আচার-অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত বিভিন্ন উপকরণ, ধর্মীয় রীতি-নীতি, বিধি-নিষেধ ও ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে যথেষ্ট ধর্মীয় ও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি রয়েছে । তাই ধর্ম সম্পর্কে না জেনে কোন বিধি-বিধান, রীতি-নীতি ও ধর্মীয় বিশ্বাসকে অযৌক্তিক মনে করা নেহাতই বোকামি ছাড়া কিছু নয়।