রাজবলহাটের রাজবল্লভী মা-
হুগলী জেলার অন্তর্গত রাজবলহাটে দেবী রাজবল্লভী মন্দির । অপূর্ব এক দারু বিগ্রহ। লোকমতে শ্বেত কালী। পুজোর লোক ইতিহাস খুবই চমকপ্রদ। জড়িয়ে আছে বিচিত্র লোকাচার।
দেবী কালিকাকে বাঙালি কালো অথবা গাঢ় নীল রঙে দেখতেই অভ্যস্ত। তাঁর গায়ের রং জ্যোৎস্নার মতো শুভ্র এবং উজ্জ্বল।দেবীর বর্ণ ধবধবে সাদা; তাঁর ডান পা বিরূপাক্ষ শিবের মাথায় আর বাঁ পা শায়িত মহাকাল ভৈরবের বুকে। দেবী রাজবল্লভী দ্বিভূজা। তাঁর ডান হাতে একটি ছুরি আর বাঁ হাতে ধরা সিঁদুরের পাত্র। কটিদেশে ছোট ছোট হাতের কোমরবন্ধ, গলায় নরমুণ্ডের মালা। সব মিলিয়ে দেবী কালিকার সঙ্গে রাজবল্লভীর অনেক সাদৃশ্য। তবে গায়ের রং সাদা অর্থাৎ শ্বেত হওয়ার কারণে তাঁকে “শ্বেতকালী” নামে ডাকা হয়ে থাকে।
হুগলি জেলার শ্রীরামপুর মহকুমার অন্তর্গত রাজবলহাট অঞ্চল বর্তমানে সামান্য একটি স্থানে পরিণত হলেও অতীতে এই অঞ্চল ছিল ভূরিশ্রেষ্ঠ রাজ্যের রাজধানী। সাল ১১৯২ খ্রিঃ, দিল্লীতে মহম্মদ ঘোরীর রাজত্বকাল। সেইসময় ভূরিশ্রেষ্ঠ রাজ্যের অধিপতি হন শনিভাঙ্গর। তারপর চতুরানন ধীবর রাজা শনিভাঙ্গরকে পরাজিত করে ভুরশুট রাজ্যের রাজা হন। আনুমানিক ৪০ বছর তিনি রাজত্ব করেন। পরে নিজ জামাতা রাজা সদানন্দ রায়কে সিংহাসনে অভিষিক্ত করেন।
একদিন রাজা সদানন্দ রায় দামোদর ও রণ নদীর মধ্যবর্তী জঙ্গলাকীর্ণ এক অঞ্চলে শিকারে করতে যান। সেখানে কিছু বন্য শুয়োর ও হরিণ শিকার করার পর রাজধানী ফিরে গিয়ে প্রাণীহত্যায় পাপ করেছেন এই ভেবে তাঁর মন ব্যাকুল হয়ে পড়লে তিনি গুরুদেবের কাছে সমস্ত কিছু ব্যক্ত করেন এবং রাজ্যপাঠ ছেড়ে যোগী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এরপর তিনি গুরুদেবের কাছ থেকে শক্তিমন্ত্রে দীক্ষা লাভ করেন এবং সেই গুরুদেবের উপদেশেই যেখানে শিকারে গিয়েছিলেন সেই জঙ্গলে শবসাধনায় ব্রতী হন। ওই সাধনাকালেই মহামায়া দ্বিভূজা, ষোড়শী রমণীমূর্তিরূপ রাজাকে দেখা দেন। আদেশ করেন, সেই জায়গাতেই যেন তাঁর মূর্তি প্রতিষ্ঠা ও পুজোর ব্যবস্থা করা হয় এবং রাজা পুনঃরায় যেন নিজের রাজ্যপাটে মন দেন। এরপরই রাজা সদানন্দ রায় জঙ্গল পরিস্কার করিয়ে সেই স্থানে বরাভয়দায়িনী, নৃমুন্ডমালিনী, শ্বেত কালিকা দেবী মায়ের প্রতিষ্ঠা করেন। রাজা দ্বারা প্রতিষ্ঠা করা নগরের নাম হয় রাজপুর। দেবীর নাম রাজবল্লভী। সময়টা ত্রয়োদশ শতকের মাঝামাঝি।
নতুন নগর প্রতিষ্ঠা করার পর রাজা সদানন্দ জায়গাটিকে চারটি চক এবং চোদ্দটি পাড়ায় বিভক্ত করেন। নগরের মধ্যভাগে বিশাল তিনটি দীঘি খনন করান। দেবীর নিত্যভোগে সেই দীঘির মাছের ব্যবস্থা করেন এবং মাছ ধরার জন্য জেলেদের নিয়ে এসে নগরের পূর্বপ্রান্তে বসতি স্থাপন করান। দেবীর পরিধানে তাঁতের শাড়ির জন্য নদীয়ার ফুলে থেকে তন্তুবায় লম্বোদর শীলকে নিয়ে আসেন। নিত্য ভোগের পাত্রের জন্য নগরের পশ্চিমে কুমোরপাড়া স্থাপন করেন। ভোগে দুধ এবং ছানার জন্য নগরের উত্তরে গোয়ালাদের বসতি তৈরি করিয়ে দেন। দেবীর মন্দির রক্ষার জন্য মন্দিরের কিছু দূরে একটি গড় স্থাপন করেন, যা লস্করডাঙ্গা নামে পরিচিতি পায়। এইভাবেই ধীরে ধীরে পূর্ণতা পায় ভূরিশেষ্ঠ রাজ্যের নতুন রাজধানী রাজপুর।
ষোড়শ শতাব্দীতে রাজা রুদ্রনারায়ণ দ্বারা বর্তমান মন্দিরটি নির্মিত হয় এবং ১৩৪০ বঙ্গাব্দে স্থানীয় কতিপয় ব্যক্তিদের অর্থানুকুল্যে মন্দিরটির আমূল সংস্কার সাধিত হয়। ১৩৪৬ বঙ্গাব্দে মন্দিরের সামনের নাট মন্দিরটি নির্মান করা হয়। মা রাজবল্লভী দেবীর মন্দিরটি একটি একটি সাধারণ পাকা গৃহ। এর সামনের বিস্তৃত প্রাঙ্গন প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত। মন্দিরের প্রবেশপথে নহবতখানা আছে। নুবতখানার পরে দেউড়ীতে কয়েকটি আটচালার ঘর আছে। এর মধ্যে একটি ঘরে একটি জলঘড়ি সংরক্ষিত আছে। প্রতি বত্সর শারদীয়া দুর্গাপুজোর সময় জলঘড়ি থেকে সময় নিরুপণ করে দেবীর পূজার্চ্চনা করা হয়। মন্দিরের প্রাঙ্গনে জোড়াশিব মন্দিরে দুটি শিবলিঙ্গ এবং দেবীর মন্দিরের সামনের পাকা নাটমন্দিরে একটি মন্দিরে বুড়া শিব বা বাণলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত আছেন।প্রতি বছর চৈত্র মাসে বুড়া শিবের গাজন ও চড়ক উত্সব অনুষ্ঠিত হয়।
এই গ্রামে দেবী রাজবল্লভীর আবির্ভাব সম্পর্কে কিংবদন্তী আছে যে, এই স্থানে জনৈক মালাকারের ঘরে একসময় এক নামগোত্রহীন বালিকা এসে উপস্থিত হয়। বৃদ্ধ মালাকার বালিকার মাতাপিতার সন্ধান করতে না পেরে মায়াবশত তাঁকে নিজের ঘরেই লালন পালন করতে থাকেন। একদিন কাছের নদী দিয়ে এক ধনবান সওদাগর সপ্তডিঙ্গা সাজিয়ে নৃত্য-গীত ইতাদি আমোদ আহ্লাদ করতে করতে যাচ্ছিলেন। উক্ত বালিকাটি এই গান শুনে মাঝিদের নৌকা থামাতে বলেন। কিন্তু নৌকার সওদাগর বালিকাটির রূপে আসক্ত হয়ে কামসক্ত হয়ে তাঁকে অপহরণ করার জন্য নৌকায় তুলতে যান। আশ্চর্য্যের ব্যাপার, বালিকাটি পরপর ছয়টা নৌকায় পাদস্পর্শ করামাত্র একটি একটি করে ছয়টি নৌকা নদীগর্ভে নিমজ্জিত হয়।
সপ্তম নৌকায় বালিকা ওঠার সময় দৈববাণী হয়, এই বালিকা স্বয়ং মা ভগবতী। তখন সওদাগর নিজের কৃতকর্মের জন্য দেবীর কাছে প্রার্থনা ভিক্ষা করেন এবং দেবী সন্তুষ্ট হয়ে এই স্থানে তাঁর মন্দির নির্মাণ করে নিত্যপূজার ব্যবস্থার নির্দেশ দিয়ে নিজে অন্তর্হিত হন। সওদাগরের নিমজ্জিত ছয়টি নৌকাই ভেসে ওঠে আর তিনি দেবীর নির্দেশ অনুযায়ী রাজবল্লভীদেবীর পূজার ব্যবস্থা করেন। আগে এইস্থান দিয়ে নদী প্রবাহিত হত আজ সেই নদীর কোন চিহ্ন নেই। আজো সেই ঘটনাকে স্মরণ করে শারদীয়া মহানবমীর দিন মন্দিরের সামনের দেবী পুকুরে সাতটি ছোট কাঠ দ্বারা নির্মিত নৌকা ভাসিয়ে পর পর ছয়টি নৌকাকে ডুবিয়ে সপ্তম নৌকাটিকে ভাসিয়ে রাখা হয়।
রাজবল্লভী মায়ের ডান হাতে ছুরি আর বাঁ হাতে রুধির পাত্র। মায়ের ডান পা মহাকালের বুকে, বাঁ পা বিরূপাক্ষের মাথায়। যিনি করজোড়ে দেবীর সাধনায় মগ্ন। দেবীর কন্ঠে নরমুন্ডমালা ও কোমরে মনুষ্য হস্তের কোমর বন্ধনী আছে। শরত্কালের জ্যোত্স্নাপ্রভার মত দেবীর বর্ণ। প্রতি ১২ থেকে ১৪ বছর অন্তর দেবীর নবকলেবর হয়। গঙ্গাজল আর গঙ্গামাটি দিয়ে নতুন বিগ্রহ তৈরি করা হয়। সেই মূর্তিকে শুভ অক্ষয় তৃতীয়ার দিন প্রতিষ্ঠা করা হয়। মন্দিরের দ্বার খোলে সকাল সাতটায়। এই মন্দিরের ভোগ নিবেদনেও রয়েছে একটি চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য। এখানে দেবীকে সেদ্ধ ভোগ দেওয়ার প্রথা চালু। কথিত, বহুকাল পূর্বে একবার এক ভক্ত পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তিনি মায়ের ভোগ সাঁতলানোর গন্ধে মোহিত হয়ে মন্দিরে এসে হাজির হন। কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক, মায়ের ভোগ পাননি তিনি। ফলে সেই রাতেই মা স্বপ্নাদেশ দেন। এবার থেকে যেন তাঁর ভোগ রান্না করার সময় আর সাঁতলানো না হয়, সেদ্ধ খাবার-ই যেন দেওয়া হয় তাঁকে। তবে সেদ্ধ পদ দেওয়া হলেও ভোগে কুচো চিংড়ির ঘন্ট থাকবেই। এছাড়া, দেবীকে গড়গড়ায় তামাক-ও নিবেদন করা হয় রোজ। এগারোটায় পুজো শুরু হয়ে দুপুর দেড়টায় ভোগ নিবেদন হয়। ভাত, ডাল, ঘাঁটা, তেঁতুল দিয়ে মাছের অম্বল, এবং পায়েস। এরপর সন্ধ্যারতি সাতটায়। আরতি শেষে মাকে নিবেদন করা হয় লুচি, সন্দেশ ও ছানা। সবশেষে তামাক সেজে দিয়ে দোর বন্ধ করা হয়।
রাজা সদানন্দ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত নগরের নাম রাজপুর হলেও পরবর্তীতে দেবীর নামানুসারে নগরের নাম হয় রাজবল্লভীহাট। বর্তমানে সেই নাম কিছুটা বদলে স্থানের নাম হয়েছে রাজবলহাট। রাজা সদানন্দ রায় রাজবল্লভীহাট বা রাজবলহাটে দশ বছর রাজত্ব করেন। এরপর ভূরিশ্রেষ্ঠ রাজ্যের অধিপতি হন তাঁর পুত্র রাজা কৃষ্ণ রায়।
কীভাবে যাবেন:
তারকেশ্বর লাইনে হরিপাল স্টেশনে নেমে বাস অথবা ট্রেকারে রাজবলহাট। এখান থেকে দূরত্ব মাত্র ১৬ কিলোমিটার। অথবা তারকেশ্বরে নেমেও বাস বা ট্রেকারে যেতে পারেন। এছাড়া চাইলে সরাসরি সড়কপথে-ও আসতে পারেন।
সংগহীত