‘মহালয়া শব্দের অর্থ হলো মহান যে আলয় বা আশ্রয়’ ।দিনেই পিতৃপক্ষের অবসান হয় এবং অমাবস্যার অন্ধকার দূর হয়ে আলােকময় দেবীপক্ষের শুভারম্ভ হয় । দেবী দূর্গাই হলেন সেই মহান আলয় বা আশ্রয়।
মহালায়া হলো এমন একটি দিন যে দিন ভোরবেলা বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চন্ডীপাঠ দিয়ে দিন শুরু করেন সকল বাঙালি তথা হিন্দুরা। আর এই দিনেই ভোরবেলা থেকে গঙ্গায় গিয়ে তর্পণ করেন অনেকেই।
সনাতন ধর্ম মতে এই সময়ে অর্থাৎ এই কৃষ্ণপক্ষকালে যমলোক বা পিতৃলোক থেকে পূর্বপুরুষদের প্রেত মর্ত্যলোকে বসবাস করে নিজের পরিজনদের সঙ্গে। এর পর তাঁরা আবার পিতৃলোকে ফিরে যান। এই সময়ে প্রয়াত পরিজনদের আত্মার যে সমাবেশ ঘটে তাকে বলা হয় মহান লয়। সেই শব্দ থেকেই এসেছে ‘মহালয়’ শব্দটি।
দেবী শক্তি আদিশক্তি। তিনি মঙ্গলদায়িনী করুণাময়ী। সাধক সাধনা করে সেই দেবীর বর লাভের জন্য। দেবীর মহান আলয়ে প্রবেশ করার সুযোগ করে নেন। তাই এই কারণেও দিনটিকে বলা হয় মহালয়া। মহালয়ার পর প্রতিপদ তিথি থেকে দেবী বন্দনা শুরু হয়। কোনো কোনো অঞ্চলে দেবীর আরাধনা প্রতিপদ থেকে শুরু হয়। একে বলে দেবীপক্ষ। শেষ হয় পিতৃপক্ষ।
রামায়ণ মতে –
রামায়ণ অনুযায়ী লঙ্কাবিজয় ও সীতা উদ্ধারের জন্য অকালবোধনের আগে এই অমাবস্যা তিথিতেই পিতৃপুরুষ ও মাতৃপুরুষদের উদ্দেশে তর্পণ করেছিলেন রাম। ত্রেতা যুগে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র অকালে দেবিকে আরাধনা করেছিলেন লঙ্কা জয় করে সীতাকে উদ্ধারের জন্য। আর সে সময় ছিলও বসন্ত কাল। তাই এই সময়ের দুর্গা পূজাকে বাসন্তি পূজা বলা হয় । শ্রীরামচন্দ্র অকালে-অসময়ে পূজা করেছিলেন বলে এই শরতের পূজাকে দেবির অকাল-বোধনও বলা হয় ।
রামচন্দ্র লঙ্কার যুদ্ধ ঘিরে দেবীকে অকাল সময় তিথিতে ,পূজা করেছিলেন। সেই বোধন অকাল বোধন নাম পরিচিত। শাস্ত্র মতে, অকালে কোনও পুজো অনুষ্ঠান করতে গেলে, পিতৃ মাতৃ , তথা ইষ্ট দেব , দেবী, গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তর্পণ করতে হয়। আর সেই মতোই অকাল বোধনের আগে তর্পণ করেন শ্রীরামচন্দ্র। আর মহালয়ার দিনেই তা করা হয়েছিল বলে কথিত রয়েছে। সেই থেকেই দুর্গাপুজোর আগে মহালয়ার প্রচলন।সেই অনুসারে এই মহালয়া তিথিতে যারা পিতৃ-মাতৃহীন তারা তাদের পূর্বপূরূষের স্মরন করে, পূর্বপূরুষের আত্মার শান্তি কামনা করে অঞ্জলি প্রদান করেন ।
মহাভারত মতে –
মহাভারত অনুসারে এই দিনে কর্ণ পিতৃমাতৃ পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে জলঅন্ন দান করেছিলেন, তা-ও আবার নিজের মৃত্যুর পর স্বর্গ থেকে মর্ত্যে ফিরে এসে।
আবার আর এক কাহিনী শোনা যায় যে মহাভারতে বর্ণিত রয়েছে, কর্ণের আত্মা যখন স্বর্গে বসবাস করতে শুরু করে, তখন তাঁকে খাবার হিসাবে শুধু সোনা আর রত্ন দেওয়া হয়। হতবাক কর্ণ, তখন জিজ্ঞাসা করেন, এমন দ্রব্য খাবারের জন্য তাঁকে কেন দেওয়া হল।
এরপর , তাঁকে জানানো হয় যে, দাতা হিসাবে কর্ণ সারা জীবন ধরে শুধুই সোনা আর রত্ন দান করেছেন। পিতৃপুরুষকে তিনি খাবার বা জল দেননি। তাই খাবার হিসাবে তিনি রত্ন আর সোনাই পাচ্ছেন।কথা মতো ইন্দ্রকে ১৬ দিনের জন্য মর্ত্যে গিয়ে ভুল সংশোধন করে তর্পণ করার ছাড়পত্র দেন এরপর যমরাজ। এই ১৬ টি দিনই সেই থেকে পিতৃপক্ষ নামে পরিচিত। এই তিথিতেই পূর্ব পূর্বপুরুষকে জলদান করার রীতি রয়েছে শাস্ত্রে। আর তা যদি কেউ করতে না পারেন , তাই অমাবস্যায় পিতৃপক্ষের শেষ দিনেও তর্পণ করে পূর্বপুরুষকে জলদান করা যায়।
পিতৃপক্ষ ও কিছু নিয়ম – যেহেতু এই পিতৃপক্ষের ১৬ দিন প্রেতকর্ম ও শ্রাদ্ধানুষ্ঠান সম্পন্ন হয়, তাই মনে করা হয়, এই পিতৃপক্ষে কোনও কাজই শুভ নয়। পক্ষ কেটে গেলে যে কোনও শুভ কাজ মহালয়া থেকে করা যেতে পারে।