শ্রীকৃষ্ণের দ্বাদশ যাত্রার অন্যতম ঝুলন যাত্রা।দ্বাপর যুগে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলাকে কেন্দ্র করে ঝুলন উৎসব এর সূচনা হয়েছিল। ঝুলন শব্দটি এসেছে হিন্দির ঝুলা অর্থাৎ দোলনা থেকে।
ঝুলন উৎসব কে ঘিরে রয়েছে নানা আচার-অনুষ্ঠান। তার মধ্যে অন্যতম হল দোলনায় রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তি স্থাপন করে দোলানো।শ্রাবণ মাসের শুক্লা দ্বাদশী থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত পাঁচ দিন ধরে চলে ঝুলন উৎসব।ঝুলন মানে দোলা বা দোলনা। ছোট্ট শিশুরূপী শ্রীকৃষ্ণকে দোলায় দোলাতেন মা যশোদা। পরে গোকুল-বৃন্দাবনেও গোরু চরাতে গিয়ে দোলনায় দুলে-দুলে গোপিনীদের উত্যক্ত করতেন তিনি! আবার এই দোলনাতেই রাধার সঙ্গে দুলে ভালবাসার বিভোরও হতেন। কৃষ্ণের কৈশোরে তাই দোলনা বা ঝুলনের গুরুত্ব অপরিসীম।উৎসবটি পালিত হয় শ্রাবণ মাসের একাদশী থেকে শুরু করে বলরাম পূর্ণিমা পর্যন্ত, মোট পাঁচদিন ধরে। প্রসঙ্গত, ঝুলন উৎসব পালনের কথা আছে পুরাণ ও নানা প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্রেও। ভাগবত পুরাণ, হরিবংশ এবং গীতগোবিন্দতে এই উৎসবের উল্লেখ পাওয়া যায়। শ্রাবণ মাসের বৃষ্টিমুখর ঠান্ডা পরিবেশে দোলনায় শ্রীকৃষ্ণকে দুলিয়ে উৎসব পালন করেন বৈষ্ণবরা। ভারতে অন্যতম জনপ্রিয় কৃষ্ণশাস্ত্র হরি ভক্তি বিলাস-এ এই উৎসবের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দেওয়া আছে।
ভারতবর্ষের বহুবিধ রীতি-নীতি, আচার-সংস্কার এবং পূজার্চনার মধ্যে প্রতি বছর আনন্দের মুহূর্ত সঞ্চার করে রাধা-কৃষ্ণের ঝুলন পূর্ণিমা (Jhulan Purnima)। বৃন্দাবনের কুঞ্জবনে সখীদের মাঝে সেই কোন প্রাচীন সময়ে রাধা আর কৃষ্ণ দুই ঐশী নর-নারী পরস্পরের প্রেমাস্পদ হয়ে এই ঝুলনে মেতেছিলেন, আজও সেই রীতি সমানে বয়ে চলেছে প্রতিটি হিন্দু ও বৈষ্ণবের মননে। দোল পূর্ণিমার সঙ্গেও যেমন সেই একই রাধা-কৃষ্ণের প্রসঙ্গ জড়িয়ে আছে, ঝুলনেও তাই। পশ্চিমবঙ্গের নবদ্বীপ, শান্তিপুর, মায়াপুর এবং পশ্চিমবঙ্গের বাইরে মথুরা, বৃন্দাবন ইত্যাদি স্থানে আজও মহাসমারোহে শ্রাবণী পূর্ণিমায় ঝুলন উৎসব পালিত হয়ে থাকে।
শ্রাবণ মাসের অমাবস্যার পর প্রতিপদ থেকে শুরু করে রাখি পূর্ণিমা পর্যন্ত পাঁচদিন ব্যাপী ঝুলন পূর্ণিমা পালন করা হয়। হোলি বা জন্মাষ্টমীর পর বৈষ্ণবদের অন্যতম পবিত্র অনুষ্ঠান এই ঝুলন পূর্ণিমা। তবে কোথাও কোথাও শ্রাবণ মাসের শুক্লা ত্রয়োদশী থেকে শুরু করে পূর্ণিমা পর্যন্ত তিনদিন ব্যাপীও এই ঝুলন পূর্ণিমা পালন করা হয়ে থাকে।
ঝুলন পূর্ণিমাকে একাধারে শ্রাবণী পূর্ণিমাও বলা হয়। ঝুলন পূর্ণিমার পৌরাণিক উৎস খুঁজতে গেলে দেখা যায় বৃন্দাবনে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলাকে কেন্দ্র করে দ্বাপরযুগে এই ঝুলন উৎসবের সূচনা হয়েছিল। হিন্দু পুরাণ মতে, শ্রীকৃষ্ণ দ্বাপরযুগে ঈশ্বরের অবতার হিসেবে এই পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং তাঁর বয়োঃবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বৃন্দাবন তথা নন্দালয়ে নানারকম লীলাসাধন করেছিলেন। কিশোর কৃষ্ণ আর রাধারানীর যে মাধুর্যপূর্ণ প্রেমের পরিপূর্ণ প্রকাশ বৃন্দাবনে স্থাপিত হয়েছিল তারই লীলাস্বরূপ এই ঝুলনযাত্রা পালিত হয়ে থাকে। রাধা-কৃষ্ণ বৃন্দাবনের কুঞ্জবনে বিশুদ্ধ প্রেমের আদানপ্রদানের মাধ্যমে এই জীবজগতে প্রথম প্রেমের প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন আর সেই লীলার নানারূপ এই ঝুলন-যাত্রায় ভক্তকুলের সামনে পরিবেশিত হয়। রাধা-কৃষ্ণের মূর্তি দোলনায় স্থাপন করে পূর্ব থেকে পশ্চিমদিকে ঝোলানো হয়। এখানে শ্রীকৃষ্ণ প্রকৃতির রূপক আর রাধা হলেন তাঁর পরম ভক্তস্বরূপিনী। শ্রীকৃষ্ণের নিত্য অষ্টপ্রহরের আটটি লীলার কথা বলা আছে পুরাণে যার মধ্যে একটি দিব্যলীলা হল এই ঝুলনযাত্রা। শ্রীকৃষ্ণ রাধার অষ্টসখীর সঙ্গে একত্রে বৃন্দাবন কুঞ্জে নৃত্য-গীত সহযোগে রাধার সঙ্গে দোলনায় ঝুলেছিলেন। এই অষ্টসখীর নাম পুরাণে পাওয়া যায় – ইন্দুরেখা, চিত্রা, চম্পকলতা, ললিতা, বিশাখা, তুঙ্গবিদ্যা, সুদেবী এবং রঙ্গদেবী। এই দিনে কদম গাছে দোলনা বেঁধে সখীরা রাধা-কৃষ্ণের ঝুলন পালন করেছিলেন বলেই বিশ্বাস করেন বৈষ্ণবেরা। শাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণের বারোটি পৃথক যাত্রার কথা উল্লেখ করা হয়েছে যার মধ্যে রথযাত্রা, স্নানযাত্রা, দোলযাত্রা, রাসযাত্রা ছাড়াও এই ঝুলনযাত্রা অতি বিখ্যাত যাদের একত্রে ‘দ্বাদশযাত্রা’ বলা হয়। ঝুলনলীলাকে অনেকে হিন্দোলনলীলাও বলে থাকেন। শাস্ত্রমতে রাধা হলেন কৃষ্ণেরই অংশ, কৃষ্ণের শরীরের বামভাগ থেকে তাঁর জন্ম। তিনি কৃষ্ণের পরম ভক্তস্বরূপিণী, কৃষ্ণপ্রেমে তিনি পাগল, কৃষ্ণের পরম আরাধ্যা দেবী তিনিই। তাই কৃষ্ণকে পেতে গেলে রাধার উপাসনাও অবশ্যকর্তব্য। রাধার কৃপা থাকলে অতি সহজেই কৃষ্ণকে লাভ করা যায়। আবার রাধার শক্তিতে কৃষ্ণ বলবান, তাই এরা এক ও অভিন্ন। বৈষ্ণব তত্ত্বে একে বলে অদ্বৈতভেদাভেদ। রাধাকৃষ্ণের প্রেমময় মূর্তিকে দোলনায় স্থাপন করে মূর্তিযুগলকে ঝোলানো, পাঁচদিন ধরে তাঁদের নানারকম সাজে সাজানো, প্রেমভক্তি, নামগান, বৃন্দাবনে তাঁদের বিশুদ্ধ প্রেমপর্ব সমস্তকিছু ভক্তগণের সামনে ঝুলন-যাত্রার মাধ্যমে পরিবেশন করা হয়।
ঝুলন-যাত্রার কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি পাওয়া না গেলেও মনে করা হয় দ্বাপর যুগে শ্রীকৃষ্ণ এবং রাধার উপস্থিতি ছিল। হিন্দু শাস্ত্রে যুগবিভাজনের রীতিতে তৃতীয় যুগ হল দ্বাপর। ফলে ঝুলনের সূত্রপাতও ঐ সময়েই ঘটেছে বলে ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু এর উদযাপনের সময়কাল ভারতে একেক প্রদেশে একেকরকম।
ঝুলন-যাত্রায় অংশগ্রহণ করতে পৃথিবীর নানা জায়গা থেকে মানুষ পশ্চিমবঙ্গের নবদ্বীপ, মায়াপুর, শান্তিপুরে ছুটে আসেন। শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মস্থান নবদ্বীপ এবং বিশেষত মায়াপুরে যেরকমভাবে এই ঝুলন উৎসব পালিত হয় তা পশ্চিমবঙ্গের অন্য কোথাও বিশেষ দেখা যায় না। কৃষ্ণের বাল্যকাল থেকে কিশোর বয়স পর্যন্ত নানা কার্যকলাপ পুতুল দিয়ে সাজানো হয়ে থাকে যা ঝুলনের বিশেষ আকর্ষণ। ভক্তেরা বিশ্বাস করে এই ঝুলন উৎসবে রাধা-কৃষ্ণকে দোলনায় দোলালে কৃষ্ণ বেশি খুশি হয়ে থাকেন। পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে নদীয়ার শান্তিপুরে, বরানগরের পাঠবাড়ি আশ্রমে, বউবাজারের বিখ্যাত রামকানাই অধিকারীর ঝুলনবাড়িতে ঝুলন যাত্রার উৎসব দেখার জন্য বহু দর্শক সমাগম হয়। একসময় বউবাজারের এই ঝুলনবাড়ির উৎসবের প্রধান আকর্ষণ ছিল ধ্রুপদী সঙ্গীতের আসর যা এখন সম্পূর্ণ হারিয়ে গেছে। এছাড়া মেদিনীপুরের মহিষাদল রাজবাড়িতে প্রায় দুশো বছর ধরে সমানভাবে ঐতিহ্যমণ্ডিত মদনমোহন গোপালজীউর মন্দিরে রাধা-কৃষ্ণের ঝুলন অনুষ্ঠিত হয়। তবে শুধুই পশ্চিমবঙ্গে নয়, সমগ্র ভারতের মধ্যে আমেদাবাদের কৃষ্ণ মন্দির, ভুবনেশ্বরের কাঠিয়াবাবার আশ্রম, বৃন্দাবনের বাঁকেবিহারী, মথুরার দ্বারকাধীশ মন্দির প্রভৃতি স্থানেও মহা ধুমধাম করে ঝুলন পূর্ণিমা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।