বছরভর নানা অনুষ্ঠান উদযাপন পালন করেন ভারতবাসীরা। ভারতবর্ষ উৎসব প্রধান দেশ। ভারতের ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গে মূলত এই উৎসব বিশেষ উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালন করা হয়।
বিশেষ তিথিতে ধুমধাম করে রথযাত্রার উৎসব পালিত হয় পুরী, মাহেশ, ইস্কনের মন্দিরে। শুধু তাই নয়, যে সমস্ত মন্দিরে ও বনেদি বাড়িতে জগন্নাথ দেব আছেন, সেখানেও ঘটা করে পালন করা হয় এই উৎসব। জগন্নাথধাম পুরী ঘিরে প্রচলিত রয়েছে একাধিক কাহিনী।
- অনেকে মনে করেন, জগন্নাথদেবের রথযাত্রা উৎসব সনাতন ধর্মের অন্যতম প্রধান একটি উৎসব। দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর কৃষ্ণের বৃন্দাবন প্রত্যাবর্তনের স্মরণে রথযাত্রা উৎসব আয়োজিত হয়ে থাকে।
- রথযাত্রার আরও একটি পৌরাণিক কাহিনি শোনা যায়। আনুমানিক সাতশো বছর পুরনো পুরীর রথযাত্রা উৎসব। এই যাত্রা নাকি দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল এবং দুটি ভাগে তিনটি করে মোট ছয়টি রথ বের হতো। রথযাত্রার রাস্তায় পড়তো বলাগুন্ডি নালা। ফল স্বরূপ দেবতাদের মূর্তি মাঝপথে রথ থেকে নামিয়ে নালা পার করে নতুন রথে রাখা হতো। এরপর রাজা কেশরী নরসিংহের আমলে এই নালা বন্ধ হওয়ার পর থেকে ৩ টি রথেই পুরীর রথযাত্রা সম্পন্ন হয়। সেই রীতি এখনও মেনে চলা হয়।
- অন্যদিকে ওড়িশার প্রাচীন পুঁথি ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ থেকে জানা যায়, এই রথযাত্রা উৎসব চলে আসছে সত্যযুগ থেকে। সেই সময়ে হঠাৎ একদিন মালব দেশের (ওড়িশা) রাজা ইন্দ্রদ্যুন্ম স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন একটি বিষ্ণু মন্দির গড়ার। কিন্তু সেই মন্দির দেখতে কেমন হবে তাঁর বিশেষ ধারণা ছিল না। মন্দির স্থাপন করে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার মূর্তি তৈরি করেন বিশ্বকর্মা। কিন্তু ইন্দ্রদ্যুন্ম অসন্তোষ প্রকাশ করায় মূর্তি নির্মাণ অসম্পূর্ণ রেখেই চলে যেতে হয় বিশ্বকর্মাকে।
- আবার কথিত আছে, শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে রথে চড়ে দাদা বলরাম ও বোন সুভদ্রাকে দেখতে যান জগন্নাথদেব। সেইজন্যে ওই তিথি মেনেই গুন্ডিচা মন্দিরে জগন্নাথ দেবের রথযাত্রার আয়োজন হয়। এই যাত্রাকে সোজা রথযাত্রা বলা হয়। এর ঠিক সাত দিন পর তার ফিরে আসা উল্টোরথ বলে পরিচিত।
পুরাতত্ত্ববিদ ও ইতিহাসবিদদের মতে এই গুন্ডিচা, রাজা ইন্দ্রদ্যুন্মের স্ত্রী। আজও পুরীর এই রাজবংশ বর্তমান এবং বংশপরম্পরায় রাজা উপাধিতে অনেকেই ভূষিত হয়েছেন। তাঁদের হাত ধরেই পুরীর রথযাত্রায় পুষ্পাঞ্জলি প্রদান থেকে, সোনার ঝাড়ু ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে।
রথযাত্রা উপলক্ষে, পুরীর রথে জগন্নাথ মহাপ্রভুর দর্শন হওয়া খুব শুভ বলে বিবেচিত। জগন্নাথ, শুভদ্রা ও বলভদ্রর জন্য তিনটি রথ তৈরি করা হয়। যা দেখার জন্য ফি বছর ভিড় জমান লক্ষ লক্ষ ভক্ত ও দর্শনার্থী। এটা বিশ্বাস করা হয় যে, কোনও ব্যক্তি যদি রথযাত্রায় পূর্ণ নিষ্ঠার সঙ্গে অংশ নেন, তাহলে জন্ম ও মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্ত হয়ে উঠতে পারেন তিনি। রথযাত্রা উপলক্ষে বিভিন্ন স্থানে মেলার আয়োজন করা হয় প্রতি বছর। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে এই উৎসব উপলক্ষে যাত্রাপালাও মঞ্চস্থের রীতি বেশ জনপ্রিয়।
ওড়িশার প্রাচীন পুঁথি ব্রহ্মাণ্ডপুরাণে রথযাত্রা
রথযাত্রা ওড়িশার প্রাচীন পুঁথি ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ অনুযায়ী, সত্যযুগ থেকে চালু হয়েছে। কথিত রয়েছে, সেই সময় সেখানের রাজা ইন্দ্রদ্যুন্ম স্বপ্ন দেখেছিলেন, বিষ্ণু মন্দির তৈরি করার, মন্দির স্থাপন করে জগন্নাথ , বলরাম, সুভদ্রার মূর্তি তৈরি ঘিরে বিশ্বকর্মাকে অসন্তুষ্ট করে ফেলেন ইন্দ্রদ্যুন্ম, সেই কারণেই দেবদেবীদের সম্পূর্ণ মূর্তি নির্মাণ না করেই চলে যেতে হয় বিশ্ব কর্মাকে। এদিকে, কথিত রয়েছে, যে শুক্লপক্ষের দ্বিতীয় তিথিতে রথে চড়ে দাদা বলরাম ও বোন সুভদ্রাকে দেখতে যান জগন্নাথদেব। সেই উপলক্ষ্যে ওই তিথি মেনেই মন্দিরে জগন্নাথ দেবের রথযাত্রার আয়োজন হয়। এই যাত্রাকেই রথ যাত্রা বলা হয়। এরপর সাত দিন পর মন্দির থেকে দেবতার ফেরার যাত্রাকে উল্টোরথ যাত্রা বলা হয়।
রথযাত্রা হিন্দুদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব। এতে রথের ওপর দেবতাদের মূর্তি স্থাপন করে রথ চালানো হয়। বিভিন্ন পুরাণে বিভিন্ন দেবদেবীর রথযাত্রার উল্লেখ আছে, যেমন: ভবিষ্যপুরাণে সূর্যদেবের রথযাত্রা, দেবীপুরাণে মহাদেবীর রথযাত্রা, পদ্মপুরাণ, স্কন্দপুরাণ ও ভবিষ্যোত্তরপুরাণে বিষ্ণুর রথাযাত্রা বর্ণিত হয়েছে। বিভিন্ন দেবদেবীর রথযাত্রার সময়কালও বিভিন্ন; কোথাও বৈশাখ মাসে, কোথাও আষাঢ় মাসে, আবার কোথাও কার্তিক মাসে রথযাত্রার অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। এই অনুষ্ঠান হয় আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে, আর একাদশী তিথিতে হয় প্রত্যাবর্তন বা ফিরতি রথ। অর্থাৎ রথটি প্রথম দিন যেখান থেকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়, আটদিন পরে আবার সেখানেই এনে রাখা হয়। একেই বলে উল্টা রথ। রথযাত্রা বা রথদ্বিতীয়া ভারতীয় রাজ্য ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গে বিশেষ উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালিত হয়। দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর কৃষ্ণের বৃন্দাবন প্রত্যাবর্তনের স্মরণে এই উৎসব আয়োজিত হয়ে থাকে। দেশের সর্বাধিক প্রসিদ্ধ রথযাত্রা ওড়িশার পুরী শহরের জগন্নাথ মন্দিরের রথযাত্রা। পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল, হুগলির মাহেশ কলকাতা ও বাংলাদেশের ধামরাই জগন্নাথ রথ ইসকনের রথ বিশেষ প্রসিদ্ধ। রথযাত্রা উপলক্ষে বিভিন্ন স্থানে মেলার আয়োজন করা হয়। পশ্চিমবঙ্গে রথযাত্রার সময় যাত্রাপালা মঞ্চস্থের রীতি বেশ জনপ্রিয়। রথযাত্রার দিন পুরীর জগন্নাথ মন্দির সহ দেশের সকল জগন্নাথ মন্দিরে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি সর্বসমক্ষে বের করা হয়। তার পর তিনটি সুসজ্জিত রথে (কোনও কোনও জায়গায় একটি সুসজ্জিত সুবৃহৎ রথে) বসিয়ে দেবতাদের পূজার পরে রথ টানা হয়। পুরীতে রথ টানতে প্রতি বছর লক্ষাধিক পুণ্যার্থীর সমাগম হয়। এখানে তিন দেবতাকে গুণ্ডিচা মন্দিরে জগন্নাথদেবের মাসির বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। পুরীতে বছরে এই এক দিনই অহিন্দু ও বিদেশিদের মন্দির চত্বরে এসে দেবদর্শনের অনুমতি দেওয়া হয়। পুরীতে যে রথগুলি নির্মিত হয় তাদের উচ্চতা ৪৫ ফুট। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক টেলিভিশন চ্যানেলে এই রথযাত্রা সরাসরি সম্প্রচারিত হয়।
বিদেশে রথযাত্রা
১৯৬৮ সাল থেকে ইসকন হরে কৃষ্ণ আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে সারা বিশ্বের বিভিন্ন শহরে রথযাত্রা শুরু হয়। এই সংঘের নেতা এ সি ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ লন্ডন, মন্ট্রিল, প্যারিস, নিউ ইয়র্ক, টরেন্টো, ভেনিস প্রভৃতি শহরে রথযাত্রা উৎসবের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করতে সক্ষম হন। ধামরাই রথযাত্রা বাংলাদেশের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ রথ উৎসব।