বাংলার সাথে শ্রী রামচন্দ্রের এক নিবিড় সম্পর্ক। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে বিভিন্ন প্রান্তে রামচন্দ্রের জন্মোৎসব হিসেবে রামনবমীর দিনটিতে রামচন্দ্রের পুজোর একটা ব্যাপক প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। বেশকিছু বনেদি পরিবারের সন্ধান পাওয়া গেছে যেখানে বহু বছর ধরে শ্রীরামচন্দ্র পরিবারের কূলদেবতা রূপে সারা বছর পুজো পাচ্ছেন,এছাড়াও বাংলায় রামচন্দ্রের ব্যাতিক্রমী দারুবিগ্ৰহ, ধাতু নির্মিত বিগ্রহ কিংবা প্রস্তর নির্মিত বিগ্ৰহের খোঁজ পাওয়া গেছে অনেক জায়গায়।
আবার অনেক পরিবারে শালগ্রাম শিলাকেও রঘুবীর বা রামচন্দ্র জ্ঞানে পুজো করা হয়। তবে বাংলা জুড়ে রামচন্দ্রের সার্বজনীন বা বারোয়ারী পুজোর সূচনায় হাওড়া জেলার রামরাজাতলার রাম মন্দিরের কথা অবশ্যই বলতে হয়। শহর হাওড়ার বুকে অবস্থিত এই মন্দিরের প্রাচীনতা কম করে হলেও ৩০০ বছর তো হবেই।
কীভাবে শুরু হলো রামরাজাতলার এই পুজো?
সেই সময়ের আয়না ধরেই দেখে নেব পুজো প্রচলনের ইতিহাসটা। অবশ্য সেই ইতিহাস নিয়েও অনেক টানাপোড়েন আছে। ধর্মপ্রাণ অযোধ্যারাম চৌধুরী, যিনি শ্বশুরকূল থেকে প্রাপ্ত সাঁতরাগাছির বিশাল জমিদারির ভাগ পেয়েছিলেন, তাঁর হাত ধরেই রামরাজাতলায় রাম পুজোর সূচনা হয়।
স্বপ্নাদেশ
প্রতিটি মন্দির বা দেবালয় প্রতিষ্ঠার পিছনে থাকে একাধিক কিংবদন্তী, স্বপ্নাদেশের কথা। আমাদের আলোচ্য মন্দিরের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম কিন্তু ঘটেনি। ধর্মপ্রাণ অযোধ্যারাম চৌধুরী একদিন অযোধ্যাপতি শ্রীরামচন্দ্রের স্বপ্নাদৃষ্ট হন, স্বপ্নাদেশ পাওয়ার পরই অযোধ্যারাম রামচন্দ্রের পুজো শুরু করার সংকল্প করেন। কিন্তু কী বেশে তাঁর আরাধনা হবে সেটা নিয়ে তিনি চিন্তিত হলেন। তখন ডাক পড়ল বাংলার ন্যায়শাস্ত্রের পন্ডিত হলধর ন্যায়রত্নের, তিনি এসে স্বপ্নাদেশের কথা শুনে বিধান দিলেন বনবাসী রামচন্দ্রকে নয় বরং বন থেকে ফিরে এসে প্রজাপালক রামচন্দ্রের রাজ্যাভিষেকের সপার্ষদ মূর্তি নির্মাণ ও তার পুজো করাই শ্রেয়।
পন্ডিতের কথা মত শুরু হলো রামের সপার্ষদ মূর্তিতে আরাধনা। সেই স্বপ্নাদেশের রূপায়নে তিনি উদ্যোগী হন বিশালাকার এবং বারোয়ারি পুজোর আদলে রামসীতার পূজার্চনা শুরু করেন। কিন্তু সেই সময় ওই এলাকায় অর্থাৎ, বর্তমান যেখানে রাম মন্দির সেখানে ঘটা করে বারোয়ারি সরস্বতী পুজো হতো এবং আপামর গ্রামবাসী এই পুজোয় মেতে উঠতেন। ফলে একদল গ্রামবাসী রাম পুজোর বিরোধিতা করলেন। দু – দলের ধারাবাহিক আলোচনায় শেষমেষ এই সিদ্ধান্ত হলো যে, রামসীতার পুজোই বড় করে হবে, কিন্তু সরস্বতী পুজোর দিন প্রতিমা নির্মাণের সূচনা হবে বাঁশ কাটা এবং প্রারম্ভিক পুজোর মধ্য দিয়ে, আর রামসীতার মূর্তির উপরে অবস্থান করবেন বিদ্যার দেবী সরস্বতী।
সেই থেকেই এখনও অবধি সরস্বতী পুজোর দিন ষষ্ঠীতলার নির্দিষ্ট বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কাটার পরে চৌধুরীপাড়ায় শিবমন্দিরে বাঁশটি পুজোর মাধ্যমে রামসীতার মূর্তি গড়ার প্রাথমিক প্রস্তুতি শুরু হয়। ওই পুজো করা বাঁশ রামচন্দ্রের মূর্তি গড়তে ব্যবহার করা হয়। এর অল্প কিছুদিন পর থেকেই মন্দির সংলগ্ন আটচালায় কুমারটুলির প্রতিমা শিল্পীরা প্রতিমা নির্মাণ শুরু করেন। বার্ন কোম্পানির তৈরি করা বিশাল এক লোহার ট্রলির উপর মূর্তি র কাঠামো তৈরি হয় এবং এই বড়ো লোহার চাকা লাগানো ট্রলির রামচন্দ্র সপরিবারে অবস্থান করেন। পুজো শুরুর প্রথমদিকে তিন দিন ধরে পুজো ও মেলা চলতো, তারপর ধীরে ধীরে ভক্ত সমাগম বাড়ার সাথে সাথে পনেরো দিন, একমাস বর্তমানে চারমাস ধরে অনুষ্ঠিত হয় রাম রাজার পুজো।
কবে ও কখন হয় এই রাম উৎসব?
রাম নবমীর দিন মহাসমারোহে রামের বিরাট মূর্তির পুজো শুরু হয়, চলে শ্রাবণ মাসের শেষ রবিবার পর্যন্ত। চার মাস ব্যাপী চলে মেলাও, বহু ভক্ত রামচন্দ্রের দর্শন করতে আসেন ওই সময়। প্রত্যহ শ্রীরামচন্দ্রকে মিষ্টান্ন, ফল, অন্নভোগ সহযোগে পুজো করা হয়,সন্ধ্যায় হয় সন্ধ্যারতি।
মন্দিরের সম্পত্তি
মন্দিরের ২৭ কাটা সম্পত্তির মধ্যে আছে বাজার, পুকুর এবং বেশ কিছু দোকানঘর। ঠাকুরের নির্দিষ্ট ভোগের ঘর আছে। প্রতিদিন সামান্য কিছু দক্ষিণার বিনিময়ে বাড়িতে ভোগ নিয়ে যাবার ব্যবস্থা আছে। মন্দিরের সম্পত্তি থেকে যা আয় হয় তা দিয়ে ভালোভাবেই চলে পুজোর খরচ, এছাড়া ভক্তদের দানতো আছেই।
রামরাজাতলার রামচন্দ্র অনন্য কেন?
এখানকার রামচন্দ্রের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে রামচন্দ্রের বিশাল গোঁফ যা সত্যিই অভিনব এছাড়াও রামচন্দ্রের সঙ্গে থাকেন মহাদেব, ব্রম্ভ্রাসহ মোট ২৬ টি প্রতিমা। অবশ্যই রামসীতার মাথার উপরের দিকে অবস্থান করছেন বিদ্যাদেবী সরস্বতী। এছাড়াও আছেন জগতের ধারণকারিনী মা জগদ্ধাত্রী-র দুটি মূর্তি, এক্কেবারে উপরে বসুদেব, রামের দুইপাশে একে একে লক্ষণ, ভরত, শত্রুঘ্ন, বিভীষণ, হনুমান, জাম্বুবান, শিবের অনুচর নন্দী-ভৃঙ্গি। পাশে আলাদা ভাবে আছে মহাবীর হনুমানের মূর্তি, সাবিত্রী-সত্যবান এবং বিষ্ণুর বামন অবতারের মূর্তির আলাদা মন্দিরকক্ষ।
কথিত আছে শ্রীশ্রী মা সারদা একবার নাকি এখানে রামচন্দ্রের দর্শন করতে এসেছিলেন।
চারমাস ব্যাপী রাম-পুজোর সমাপ্তি ও বিসর্জন
চারমাস ব্যাপী পুজো সমাপ্ত হয় শ্রাবণ মাসের শেষ রবিবার। বর্নাঢ্য শোভাযাত্রা সহকারে বিশাল মূর্তি গঙ্গাবক্ষে বিসর্জন করা হয়। রামবিজয়া দেখতে বহু দূর দূর থেকে মানুষ আসেন। রাস্তার দুধারে শুধু মানুষের ভিড় সবার মুখে একটাই জয়ধ্বনি “রামচন্দ্র কী জয়“। কী অদ্ভূত উন্মাদনা সকলের চোখেমুখে ধরা পরে। সপার্ষদ রামরাজা সহ লোহার চাকা লাগনো ট্রলি অগনিত ভক্ত টেনে নিয়ে চলেন গঙ্গার দিকে। ওই সময় সুন্দর ফুলের সাজে সজ্জিত হন প্রভু। দীর্ঘ চার মাস ব্যাপী মেলা সেবছরের মতো ওই দিনই শেষ হয়। একটা সময় পুজোকে উপলক্ষ করে চলতো কবিগান, কীর্তন, যাত্রাপালা এবং সংস্কৃত নাটকের আসর। বর্তমানে সেসব অবশ্য হয় না।
এই সময় দাঁড়িয়ে হাওড়া জেলা তথা গোটা বাংলা জুড়ে রামপুজোর পরিমাণ আগের থেকে অনেক বেড়েছে। কিন্তু ঐতিহ্য ও প্রাচীনতার দিক দিয়ে রামরাজাতলার রামপুজোর স্বাতন্ত্র্যতা আজও অটুট।
লিখনেঃ Suddhasil Ghosh