জৈষ্ঠ্য অমাবস্যা বা ফলহারিণী কালী পূজা জনপ্রিয় উৎসব। নিষ্ঠা মেনে এই পূজা করা হয় বিভিন্ন মন্দিরে। আসলে বাংলায় শক্তিপূজা মাত্রই জনপ্রিয়। দূর্গা বা কালী পূজাকে সরাসরি শক্তিপূজা হলেও, লক্ষ্মী বা সরস্বতী পূজার মাধ্যমেও সেই মহাশক্তিরই আরাধনা করা হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে মনে যে শক্তি বলতে আমরা কালী বা দুর্গাকেই কেন বুঝি?
সে ক্ষেত্রে শিবপূজাও শক্তিপূজা বলা যেতে পারে কারন শিব হল ধ্বংসের দেবতা বা প্রলয়ের দেবতা যা এক কথায় শক্তিকেই প্রদর্শন করে… কিন্তু আমাদের জেনে রাখতে হবে যে এই ‘শক্তি’ কথাটি স্ত্রী বাচক, অর্থাৎ শক্তিপূজা বলতে নারী বা মাতৃ পূজাই বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ ব্রক্ষ্মা, বিষ্ণু বা মহেশ এর মধ্যে যে সৃজনীশক্তি পালনীশক্তি বা রৌদ্রশক্তির প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় তা নারী শক্তিরই বর্হিপ্রকাশ মাত্র। শোনা যায় সৃষ্টির অন্তিমলগ্নে যখন ধ্বংস আসন্ন তখন ব্রক্ষ্মা, বিষ্ণু আদি দেবতা গন তাঁদের স্বীয় কার্য সম্পন্ন করেছেন এবং লীন হয়েছেন , কারন সৃষ্টি ও স্তিতি তখন সমাপ্ত। রুদ্র তাঁর বিনাশ সম্পন্ন করা মাত্রই তিঁনিও লীন হলেন। এই মহাকালাদি দোবতাদের যিনি কলন করলেন তিনিই মহাকালী। শ্রীশ্রী চন্ডীতে বলা হয়েছে-
‘একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়া কা মমাপরা’
অর্থাৎ- এ জগতে আমিই এক এবং অদ্বিতীয়া, আমি ভিন্ন দ্বিতীয় কেউ নেই।
কেন এই পূজা করা হয়?
গৃহ ধর্মকে সুন্দর করতে এই ফলহারিনী কালী পূজা করা হয়। এটি বাৎসরিক একটি পুজা। জ্যৈষ্ঠ মাসে বিভিন্ন অশান্তি, মাহামারী থেকে রক্ষা পেতে মা কালীকে রক্ষাকালী রূপে পুজো করা হয়। আর সেই রক্ষাকালী পুজোর সঙ্গে রয়েছে ফলহারিনী অমাবস্যার তিথিও। এমন দিনে বাধা বিঘ্ন থেকে মুক্তি লাভ করতে পুজো করুন মা কালীর। জ্যৈষ্ঠমাসে আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল ইত্যাদি নানারকম ফলের মৌসুমী ফল পাওয়া যায়। সাধক তাঁর ইষ্টদেবীকে বিভিন্ন ফল দিয়ে প্রসাদ নিবেদন করে থাকেন। শাস্ত্রে বলা হয়, জীবনেয সর্বস্ব। অর্থাৎ একদিকে ফলহারিণী যা সাধকের কর্মফল হরণ করেন। অপর দিকে কর্মফল হরণ করে সাধককে তাঁর অভীষ্টফল, মোক্ষফল প্রদান করেন। ফলহারিনী অমাবস্যার দিন মা কালীকে অর্পণ করুন যেকোনও ফল। নিজের ভাগ্যকে ফিরে পেতে হলে আজ অবশ্যই মা কালীর পুজোয় ফল দান করুন। শাস্ত্রজ্ঞদের মতে মাকে তুষ্ট করতে ফল দিলেই তাঁর পুজো করতে হবে। ফলহারিনী পূজোর ফলে আমাদের মন্দভাব দূরীভূত হয়।
ঠাকুর রামকৃষ্ণ ও মা সারদার সাথে এই পুজার সম্পর্ক
বাঙালি জীবনে ফলহারিণী কালী পুজোর তাৎপর্য লুকিয়ে রয়েছে শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনে। ফলহারিণী কালী পুজোর দিন শ্রীমা সারদাকে ষোড়শীরূপে পুজো করেছিলেন বলে আজও রামকৃষ্ণমঠ ও আশ্রমে এই পুজো ‘ষোড়শী’ পুজো নামে পরিচিত। ঠাকুর রামকৃষ্ণ এই দিনেই তার সমস্ত সাধনার ধন আপন স্ত্রী সারদা দেবীকে দেবী রূপে পুজো করেছিলেন জগৎ কল্যাণের জন্য। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর মোক্ষপ্রাপ্তির জন্য এই নিয়মে পুজো করলেও এই দিনটিতে হিন্দু ধর্মাবলাম্বী মানুষ নানাবিধ ফল দিয়ে কালির পুজো করে থাকেন। ১২৮০ বঙ্গাব্দে জ্যৈষ্ঠ মাসের অমাবস্যা তিথির নিশিথে তিনি দক্ষিণেশ্বরে আদ্যাশক্তি সগুণরূপের পুজো করেছিলেন।
এই পূজার কারন মোটামুটি দুটো ধরা যেতে পারে। প্রথমত- ঠাকুরের পক্ষে নিজ কার্যে বা সাধনায় এগোতে গেলে নিজ অর্ধাঙ্গিনীর সাহায্য একান্ত ভাবে প্রয়োজন ছিল, কারন ল্ক্ষ্মী ছাড়া যেমন নারায়ন অপূর্ণ তেমনি সারদাদেবী ছাড়া রামকৃষ্ণ দেবও অসম্পূর্ন। ঠাকুর যদি মা-এর মন থেকে মানসিক আসক্তি না দূর করতে পারত, তাহলে দক্ষিনেশ্বরে থেকে তাঁর সাধনা করা কঠিন হত, তাই তিঁনি বাল্য সারদার মনে আধ্যাত্মিক ভাবধারার বিকাশ ঘটিয়ে এবং নিজের সাধনসঙ্গিনী হিসাবে সারদা কে অন্তর থেকে প্রস্তুত করলেন।
আর দ্বিতীয়ত- শ্রীমায়ের ভিতর যে সুপ্ত দেবীত্ব রয়েছে তার স্বরুপতা প্রকাশও অত্যন্ত জরুরি কারন তিনি জানতেন সারদা কোনো সাধারন মেয়ে নন, তাঁর (ঠাকুরের) অবর্তমানে তিঁনি (মা)ই হবেন এই রামকৃষ্ণের ভাবাদর্শের কান্ডারী। অর্থাৎ শ্রীমায়ের অভ্যন্তরে যে সুপ্ত দেবীশক্তি সর্বপরী মাতৃশক্তি বর্তমান ছিল তার মুক্তিই ছিল এই পূজার কারন। – কথা প্রসঙ্গে জানা যায় একদিন রামকৃষ্ণের পা টিপতে টিপতে সারদামনি একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘ আচ্ছা আমি তোমার কে?’ রামকৃষ্ণদেব উত্তর দিলেন- ‘যে মা মন্দিরে, যে মা এই শরীরের জন্ম দিয়ছেন, তিনিই সম্প্রতি নহবতে সেই আনন্দময়ী মা’।