শ্রীকৃষ্ণের জন্ম তিথিতে ১৭৩০ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ আগস্ট ১৮ ভাদ্র, ১১৩৭ বঙ্গাব্দে ২৪ পরগণার কচুয়া গ্রামে একটি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শ্রীশ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী। পিতার নাম রামনারায়ণ ঘোষাল এবং মাতা কমলাদেবী। তিনি ছিলেন তার বাবা-মায়ের চতুর্থ সন্তান। শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি অর্থাৎ জন্মাষ্টমির দিনেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি।
বাবা লোকনাথের ভ্রমন ইতিহাস
দীক্ষাগুরু হিসেবে ভগবান চন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় কয়েক বছর দেশে বাস করে লোকনাথ ও বেণীমাধব বন্দ্যোপাধ্যায় নামে শিষ্যদ্বয়কে সঙ্গে নিয়ে কালীঘাটে আসেন। পরে ভগবান গাঙ্গুলী তাঁদেরকে নিয়ে বারাণসীতে গমন করেন। দেহত্যাগ করার পূর্বে ত্রৈলিঙ্গস্বামীর হাতে ভার দিয়ে যান দুই শিষ্যের। সেখানে স্বামীজীর সঙ্গে তারা কিছুকাল যোগশিক্ষা করে ভ্রমণে বের হন বাবা লোকনাথ।
জনশ্রুতি পশ্চিম দিকে দিয়ে আফগানিস্তান, মক্কা, মদিনা ইত্যাদি স্থান ভ্রমণ করে আটলান্টিক মহাসাগর উপকূল পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন তিনি। পরে তিনি বেণীমাধবকে সঙ্গে নিয়ে উত্তরের পথে গমন করেন। তাঁরা সুমেরু এলাকা গমনের ইচ্ছায় প্রাক-প্রস্তুতি উপলক্ষে শৈত্যপ্রধান এলাকা হিসেবে বদরিকা আশ্রমে অবস্থান করেন। সেখান থেকে আধুনিক পরিজ্ঞাত সীমা অতিক্রম করে উত্তরে বহু দূর পর্যন্ত চলে যান।
সেখানে সূর্যোদয় না হওয়ায় সময় নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। তবে সে পথে তাঁরা নাকি ২০ বার বরফ পড়তে ও গলতে দেখেছিলেন। শেষে হিমালয় শৃঙ্গে বাঁধা পেয়ে তাঁরা পূর্ব দিকে গমন করে চীন দেশে উপস্থিত হন। সেখান থেকেই উভয়েই যাত্রা শুরু করে বেণীমাধব কামাখ্যায় এবং লোকনাথ বারদী গ্রামে বাস শুরু করেন। সে সময় থেকেই “বারদী’র ব্রহ্মচারী” হিসেবে লোকনাথ পরিচিতি পান। ভক্তদের কাছে সেই থেকেই তিনি বাবা লোকনাথ হিসেবেই পরিচিত।
বলছে বাবা লোকনাথকে শিব লোকনাথ কেন বলা হয়?
তথ্য অনুযায়ী গুরু শ্রী ভগবান গঙ্গোপাধ্যায়ের হাত ধরে সংসার থেকে বেরিয়ে যান। নানান ব্রত উদযাপন করে কঠোর তপস্যার জন্য চলে যান হিমালয়ে।
চারিদিকে শুধু বরফ আর বরফ। বিশাল এই বরফের গুহার মধ্যে গুরু ভগবান গঙ্গোপাধ্যায় সাধনায় বসেন। কিন্তু সেই গুহা ছেড়ে মুক্ত আকাশের নীচে বরফের আসনে ধ্যানে মগ্ন হন বাবা লোকনাথ। দিন, সপ্তাহ, মাস কোথা দিয়ে সময় চলে গিয়েছিল তা কেউ বুঝতে পারেনি। বরফের মধ্যেই ধ্যানমগ্ন লোকনাথের শরীর ঢেকে যেত। যা গুরুদেব বরফের গুহার মধ্যে থেকে দেখতেন। দিন গণনার হিসেব ছিল না। তবে লোকনাথ বাবা’র শরীরে জমা বরফ নব্বই বার গলে জল হয়ে গিয়েছিল বলে দাবি তাঁর অনুগামীদের।
আর এভাবেই গুরুদেব বুঝেছিলেন তাঁর নব্বইটি বছর পার করে দিয়েছেন। এর পরেই ঘটল সেই অবিস্বরনীয় সেই ঘটনা। পাহাড়ের গা বেয়ে ভোরের কাঁচা রোদ এসে পড়েছে বাবা লোকনাথের সিদ্ধাসনে। বরফের গুহার ভিতর থেকে গুরু ভগবান গঙ্গয়াপধ্যায় উঁকি দিয়ে দেখলেন সিদ্দ্বাসনে লোকনাথ বাবা নেই, সেখানে বসে আছেন দেবাদিদেব মহাদেব। গুরুদেব ভাবলেন “তাহলে কি ভুল দেখলাম?”
এরপরেই তিনি বরফের গুহা থেকে বের হয়ে দেখেন সিদ্ধাসনে বাবা লোকনাথই বসে আছেন। পর-মহুর্তে দেখেন সেখানে আবার লোকনাথ বাবা নেই, বসে আছেন দেবাদিদেব মহাদেব। গুরুদেব বুঝলেন, বাবা লোকনাথ আজ সিদ্ধিলাভ করেছেন। তিনি গুরু হয়েও প্রনাম করলেন শিবকল্প মহাযোগী বাবা লোকনাথ কে…..! আর এরপর থেকে লোকমুখে প্রচার হয় শিব লোকনাথের কথা।
বাবা লোকনাথের প্রচলিত ঘটনা
- বাবা লোকনাথের আধ্যাত্মিক শক্তি সম্বন্ধে অনেক কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। কেউ কেউ বলেন, তিনি জাতিস্মর। দেহ হতে বহির্গত হতে এবং অন্যের মনের ভাব অবলীলায় তিনি জানতে পারতেন।
- এছাড়াও, অন্যের রোগ নিজ দেহে এনে রোগীকে রোগমুক্ত করার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তাঁর।
- প্রচলিত আছে, একবার ডেঙ্গু কর্মকার নামের এক ব্যক্তি ফৌজদারি মামলায় হেরে যাবার সম্ভাবনা আছে বলে বাবা লোকনাথের কাছে আসেন। তাঁর প্রার্থনায় বাবা লোকনাথ তাঁকে অভয় প্রদান করেন। যে মামলাটি কোনও ভাবেই জেতার কথা নয়, সেটি হজেই জিতে যান তিনি। এরপর বাবা লোকনাথের আধ্যাত্মিক শক্তি দেখে ডেঙ্গু কর্মকার তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
- আরও একটি কথিত তথ্য পাওয়া যায়। একবার বারদীর পাশের এক গ্রামে ভয়ঙ্কর ছোঁয়াচে একটি রোগ ছড়িয়ে পড়ে। সেই সময়ে সকলে সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু বাবা লোকনাথের কৃপায় সব রোগীরা সুস্থ হয়ে ওঠেন।
- বারদীতেই যখন বাবা লোকনাথের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, তখন সেখানকার লোভী ব্রাহ্মণসমাজ তাঁকে হিংসে করা শুরু করেন। সেই গ্রামের জমিদারের ইচ্ছায় কামাখ্যা নামের এক অহংকারী কালী পূজককে বাবা লোকনাথের সিদ্ধিজ্ঞান লাভের প্রমাণ দিতে বলা হয়। কামাখ্যা, কথা দেন যে, যদি বাবা লোকনাথ সিদ্ধপুরুষ হিসেবে নিজেকে প্রমাণ দিতে পারেন, তবে তিনি তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করবেন।
- এরপর বাবা লোকনাথকে কামাখ্যা এবং শিষ্যের সহায়তায় ধুতরা ফুল এবং ভয়ঙ্কর সাপের বিষ দেওয়া হয়। স্বেচ্ছায় তা গ্রহণ করার পর সবাই চিতা সাজিয়ে রাখেন। এমনকি তাঁকে অজ্ঞানরত অবস্থায় শোয়ানো পর্যন্ত হয়। কিন্তু মশাল হাতে নেওয়ার পরে লক্ষ্য করা যায় যে, তাঁর ওপরে অবিরত ধুতরা ফুল পড়তে থাকে। এছাড়াও তিনি তাঁর মাকে বলেছিলেন যে তাঁর মায়ের হাতের দুধ তাঁর মৃত্যুকেও জয় করতে পারে। সেজন্য তাঁর মা তাকে দুধ পান করিয়ে দেন চিতায় শয়নরত অবস্থায়। কিন্তু সকলকে অবাক করে তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন। এরপরই সমগ্র ব্রাহ্মণসমাজ এবং কামাখ্যা তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
লোকনাথ বাবার বিখ্যাত বাণী ও মহামন্ত্র
‘রণে বনে জলে জঙ্গলে যখনই বিপদে পড়িবে, আমাকে স্মরণ করিও, আমিই রক্ষা করিব।’
– বাবা লোকনাথের বাণী
“জয় বাবা লোকনাথ, জয় মা লোকনাথ, জয় শিব লোকনাথ, জয় ব্রহ্ম লোকনাথ, জয় গুরু লোকনাথ।”
বাবা লোকনাথের মহামন্ত্র
বাবা লোকনাথের দেহত্যাগ
বাবা লোকনাথ, ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দের ১ জুন, ১৬০ বছর বয়সে বাংলাদেশের নারায়ণগন্জের সোনারগাঁওয়ের বারদীতে তাঁর দেহ রাখেন। কিন্তু আজও তাঁর অগণিত ভক্তেরা নিষ্ঠা করে তাঁর পুজো করেন। মনে করা হয়, মাখন ও মিছরিতেই সন্তুষ্ঠ হন বাবা।
Source: Internet & Wikipedia