কলিকাতার ইতিবৃত্ত’ বইয়ে প্রাণকৃষ্ণ দত্ত আলাদা করে বলেছেন কলকাতার রথযাত্রার কথা। শেঠদের বিশাল রথের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, লালদিঘি থেকে বৈঠকখানা পর্যন্ত প্রশস্ত রাস্তাতেই হয়তো এই রথ টানা হত। সেই রাস্তা, মানে আজকের বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিটের দু’পাশে বৌবাজার অঞ্চলে রথের ঐতিহ্য প্রাচীন, আজও একাধিক বনেদি বাড়িতে রথযাত্রা উদ্যাপিত হয়। গোবিন্দ সেন লেনের চুনিমণি দাসী প্রতিষ্ঠিত ১২৫ বছরেরও বেশি পুরনো, পাঁচ চূড়াবিশিষ্ট ত্রিতল রথ সাজানো হয় পুতুল ও দেবদেবীর ছবিতে। কাছেই গোকুল বড়াল স্ট্রিটে জগন্নাথবাড়ির বিগ্রহের ‘মাসির বাড়ি’ থাকার প্রথা নেই, শতাব্দীপ্রাচীন রথে চড়ে নানা জ্ঞাতি-বাড়ি পুজো নিয়ে জগন্নাথ ফেরেন মন্দিরে। হিদারাম ব্যানার্জি লেনে গোবিন্দলাল দত্তর বাড়িতে রথ বেরোয় না, তবে জগন্নাথ এসে বসেন ঠাকুরদালানের আসনে। এই রাস্তাতেই নীলমণি দে’র ঠাকুরবাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেই পরিবারের সদস্যেরা রথ টানেন। এখানে রথ দেখতে গিয়ে বাড়তি পাওনা অষ্টধাতুর দুর্গামূর্তি দর্শন। বৌবাজারেই যদুনাথ দত্তের ঠাকুরবাড়িতে রথে আজও নহবত বসে, পারিবারিক প্রথা মেনে। রথের পরের দিন থেকে পুনর্যাত্রার আগের দিন পর্যন্ত হয় বিশেষ পুজো, ভোগ, নিত্য বেশ বদল। ঝুলনবাড়ি-খ্যাত রামকানাই অধিকারীর ঠাকুরবাড়ি চত্বরে জগন্নাথকে ছোট রথে বসিয়ে টানা হয়।
জগন্নাথকে ঘিরে আবর্তিত পরিবারের শ্রীবৃদ্ধির গল্পও। ব্যবসায় ক্ষতির মুখে নিত্যসেবা দুষ্কর হলে গৃহকর্তা চালের জালার মধ্যে ঢুকিয়ে রেখেছিলেন জগন্নাথ বিগ্রহ। তার পরেই দিন ফেরে, জগন্নাথও ফেরেন সিংহাসনে। গৃহকর্তা শ্রীক্ষেত্রে মানত করেছিলেন, ব্যবসায় সম্বৎসরের লাভের টাকায় গড়বেন জগন্নাথ মন্দির। সে বছর লাভ হল লাখ টাকার উপর! তার পরেই, ১৮২১ সালে বৌবাজারের ৪ নং সনাতন শীল লেনে জগন্নাথদেবজিউয়ের ঠাকুরবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন স্বরূপ চাঁদ ধর। দুশো বছরে পড়ল তা।
স্বরূপ ধরের সময়েই তৈরি সুদৃশ্য কাঠের রথে চড়ে রথের দিন জগন্নাথ ঠাকুরবাড়ি থেকে বেরিয়ে বৌবাজারের কিছু অংশ ঘুরে সাত দিন থাকেন ৮ নং সনাতন শীল লেনে ধর পরিবারের অন্যতম বসতবাটির মন্দিরে। পারিবারিক রীতি অনুযায়ী রথ এসে দাঁড়ায় হিদারাম ব্যানার্জি লেনে গোবিন্দলাল দত্তের ঠাকুরদালানের সামনে। মুখোমুখি হন ধর ও দত্ত বাড়ির দুই জগন্নাথ একদা আত্মীয়তা বা ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল দুই পরিবারে। সেই ইতিহাস এখন বিস্মৃত, রয়ে গিয়েছে প্রথাটুকু। ধর বাড়ির বর্তমান সদস্য রবীন চাঁদ ধর জানালেন, রথযাত্রা থেকে সাত দিন জগন্নাথের নিত্য বেশবদল হয়— রাজবেশ, সোনার বেশ, চতুর্ভুজ ,বামন বেশ, রামচন্দ্র বেশ, পদ্মপলাশ বেশ ও কৃষ্ণ বেশ। রথের দিন জগন্নাথ পান ছাপ্পান্ন ভোগ।