‘অক্ষয়’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ যার ‘ক্ষয় বা বিকার নেই’।
কিন্তু অক্ষয় তৃতীয়া ব্যাপারটি কি? তৃতীয়া যা কিনা অক্ষয়। প্রতি বছরের বৈশাখ মাসে শুক্ল পক্ষের তৃতীয়া তিথিটিকে বলা হয় অক্ষয় তৃতীয়া। এই তিথিকে অক্ষয়তীজ্ বা পরশুরাম জয়ন্তীও বলা হয়।
এটি একটি বছরের মাহাত্ম্যপূর্ণ দিন। আবার ঐদিন যদি হয় সোমবার আর রোহিণী নক্ষত্র সমাসীন, তবে তো কথাই নেই। দিনটি হয়ে উঠে আরো গুরুত্বপূর্ণ। বৈশাখ মাসের এই বিশেষ দিনে দেখা গেছে নানাবিধ মহতী কর্মের সূচনার পরম্পরা। আমাদের অতীত ইতিহাস অবলোকন করলে এমন সব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এই দিনে ঘটতে দেখা যায় যার পরিণাম স্বরূপ আজও ক্ষয়হীন হয়ে সময়ের স্রোতের সঙ্গে নিরবধি বয়ে চলেছে। তাইতো আবহমান কাল থেকে এই দিনে অনুষ্ঠিত যে কোন শুভ কার্যানুষ্ঠানের পূণ্যফল অক্ষয় বলে ধার্য হয়। ‘অক্ষয়, তৃতীয়া’ আখ্যা তাই সার্থক।
অক্ষয় তৃতীয়া নিয়ে প্রচলিত পৌরাণিক কাহিনি:
এদিনই সত্যযুগ শেষ হয়ে ত্রেতাযুগের সূচনা হয়েছিল। এদিনই কুবেরের তপস্যায় তুষ্ট হয়ে মহাদেব তাঁকে অতুল ঐশ্বর্য প্রদান করেছিলেন। এ দিনেই কুবেরের লক্ষ্মীলাভ হওয়ায় বৈভব-লক্ষ্মীর পূজা করা হয়। রাজা ভগীরথ গঙ্গা দেবীকে মর্ত্যে নিয়ে এসেছিলেনএদিনই। প্রচলিত আছে, এ দিন গঙ্গাস্নান করলে সব পাপ ধুয়েমুছে যায়। রয়েছে এমন কত বিশ্বাস, কাহিনি ও কিংবদন্তি।
বিভিন্ন পুরাণে অক্ষয় তৃতীয়ার মাহাত্ম্য নিয়ে বেশ কিছু কাহিনি প্রচলিত।তার মধ্যে একটি হল, একবার মহামুনি শতানিক যুধিষ্ঠিরকে জলদানের মাহাত্ম্য প্রসঙ্গে একটি কাহিনি শুনিয়েছিলেন। বহু যুগ আগে এক ক্রোধী ও নির্দয় ব্রাহ্মণ ছিলেন। এক দিন এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ তাঁর কাছে কিছু খাবার চাওয়ায়তিনি গালমন্দ করে দরজা থেকেই তাঁকে তাড়িয়ে দিলেন। অপমানিত ব্রাহ্মণ চলে যাচ্ছেনএমন সময় ব্রাহ্মণপত্নীতাঁকে যেতে দিলেন না।অতিথির কাছে ক্ষমা চেয়েতাঁকে বললেন, সেখানেইআহার করতে।এর পর ব্রাহ্মণপত্নী অতিথিকেযথাসাধ্য আহার-সহআপ্যায়ন করলেন। যাওয়ার আগে সেই ব্রাহ্মণতুষ্ট হয়ে ব্রাহ্মণপত্নীকে আশীর্বাদ করে বললেন, তাঁর অন্ন-জল দান অক্ষয় হোক।
তারপর কেটেছে গিয়েছে বহু বছর। এক সময় সেই ক্রোধী ও নির্দয় ব্রাহ্মণেরমৃত্যু আসন্ন জেনে তাঁকে নিয়ে যেতে একই সঙ্গে হাজির হল যমদূত ও বিষ্ণুদূতের দল। কিন্তু তাঁকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে এই নিয়ে তুমুল বিবাদ শুরু হল দুই দল দূতের মধ্যে। একদল তাঁকে বিষ্ণুলোকে নিয়ে যেতে চাইল। অন্য দলতাঁকে নরকে নিয়ে যেতে চাইল। এরই মাঝে তৃষ্ণায় কাতর ব্রাহ্মণ একটু জল চাইলেন। যমদূতেরা তখন ব্রাহ্মণকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, অতিথি ব্রাহ্মণকে জল না দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়ার সেই ঘটনাটি।এর পরে তাঁরা ব্রাহ্মণকে যমরাজের কাছে নিয়ে গেলেন।
যমরাজ ব্রাহ্মণকে দেখেই চমকে উঠলেন। তাঁর দূতদের বললেন, তাঁর মতো পুণ্যবানকে কেন যমলোকে নিয়ে এসেছে তাঁরা? বৈশাখর শুক্লা তৃতীয়ায় ব্রাহ্মণপত্নী তৃষ্ণার্ত অতিথিকে অন্ন-জল দান করেছেন। সেই দান অক্ষয় দান। স্ত্রীর পুণ্যে তিনিও তাই পুণ্যবান হয়েছেন। আর সেই পুণ্যের ফলে ব্রাহ্মণের স্থান নরকে নয়, স্বর্গেই হবে। কাহিনি শেষে শতানিক মুনি যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন, বৈশাখ মাসের শুক্লা তৃতীয়া তিথিতে ব্রাহ্মণকে অন্ন বস্ত্র জল দান করলে সব পাপ থেকে মুক্তি লাভ করা যায়। অর্থাৎ এই দিনে কিছু দান করলে পুন্য সঞ্চয় হয়।
দ্বাপর যুগে শ্রীকৃষ্ণ তখন দ্বারকার রাজা। বাল্যসখা সুদামা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বৃন্দাবন থেকে সুদূর দ্বারকায় এলেন। দরিদ্র সুদামা কৃষ্ণের জন্য কাপড়ের পুটুলিতে বেঁধে এনেছিলেন তিনমুঠো তণ্ডুল। নানা বিষয়ে কথা হলেও সুদামা তাঁর দারিদ্রের কথা সঙ্কোচে কৃষ্ণকে বলতে পারলেন না। কৃষ্ণের কাছে কিছুই অজানা নয়। সুদামা বৃন্দাবনে ফিরে দেখেন তাঁর পর্ণকুটিরের জায়গায়রয়েছে সুন্দর এক বাড়ি। অভাব নেই কোনও কিছুরই। সেই দিনটিও ছিল অক্ষয় তৃতীয়া।
এ তিথি অতীতে, পুরাণে যে সমস্ত ঘটনাবলী ঘটছে:
- এই তিথিতে সত্যযুগের সূচনা হয়।
- এই তিথিতে পুণ্যতোয়া, পুণ্যসলিলা ভগবতীদেবী গঙ্গা মর্ত্যে অবতরণ করেন। তারপর থেকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে অক্ষয় জলসম্ভার সমেত মর্ত্যবাসীর জীবন দায়িনী তথা পাপনাশিনী নদী রূপে প্রবাহমানা।
- ভগবানের দশ অবতারের অন্যতম ষষ্ঠ অবতার ‘পরশুরামদেব’ এই তিথিতেই আবির্ভূত হন অবনীমাঝে। তিনি তো চিরঞ্জীবী। অমর, অক্ষয় আয়ু নিয়ে আজও মর্ত্তচারী। তাই এ তিথির আরেক নাম ‘পরশুরাম জয়ন্তী’।
- এই তিথিতেই ব্যাসদেব মহাভারত রচনা শুরু করেন। মহাভারতে মধ্যে ২৫ থেকে ৪২ পর্যন্ত আঠারো অধ্যায় ‘গীতা’য়, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাণী রয়েছে, যা অনন্তকাল হতে আমাদের ভবসাগর উত্তলনের অক্ষয় পথপ্রদর্শক।
- দেবী পার্বতীর অপর এক রূপ ‘মা অন্নপূর্ণা’ এই তিথিতেই আবির্ভূতা হয়ে মহাদেবকে অন্নভিক্ষা দেন। তারপর থেকে অন্নের অক্ষয় উৎসস্বরূপা দেবী পূজিতা হন।
- এই তিথিতেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পরম সখা সুদামা বিপ্র দ্বারকাতে তাঁর প্রাসাদে আসেন, নিজের দারিদ্রাবস্থার কথা জানিয়ে কিছু অর্থ সাহায্য লব্ধ হতে। কিন্তু ‘অতিথি দেবঃ ভবঃ’ এবং ‘ব্রাহ্মণ নিত্য পূজ্য’-এই জ্ঞানে শ্রীকৃষ্ণ বিপ্র সুদামাকে যে আতিথেয়তা করেন, তাতে মুগ্ধ হয়ে সুদামা আর নিজের দৈন্যাবস্থার কথা মুখ ফুটে বলতে পারেননি। এমনকি কৃষ্ণের প্রাসাদে সম্পদের বৈভব দেখে, তাঁর জন্য আনা কাপড়ে বাঁধা সামান্য চালভাজাটুকুও লজ্জায় আর দিতে পারেননি সুদামা। কিন্তু ভক্তবৎসল ভগবান বাসুদের যে ভাবগ্রাহী। তিনি ভাবটুকু গ্রহণ করেন, কেবল ভেট নয়। তাই নিজেই সেই চালভাজা খেয়ে পরম তৃপ্ত হন। আর সুদামা বিপ্র নিজমুখে কিছু না চাইলেও, বাড়িতে ফিরে দেখেন যে তার ক্ষুদ্র কুঠিরের পরিবর্তে বৃহৎ অট্টালিকা অবস্থান করছে সেখানে। শ্রী ভগবান অযাচিত করুণাভরে সবকিছু সাজিয়ে ভরিয়ে দিয়েছেন তাঁর একান্ত প্রিয় সখা তথা ভক্তপ্রবর সুদামাকে। এই লীলার দ্বারা এটাই প্রমাণ হয় যে, ভক্তের চাওয়ার অপেক্ষা করেন না ভগবান। অহৈতুকী অযাচিত কৃপা অক্ষয়রূপে তিনি নিজে থেকেই করেন তাঁর নিষ্কাম ভক্তের প্রতি। সত্যি, তাঁর মতো সুহৃদ, তাঁর মতো পরম বান্ধব আর কে আছেন?
- দুর্যোধনের নির্দেশে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করে দুঃশাসন এই তিথিতেই। কিন্তু দ্রৌপদী যখন পূর্ণ বিশ্বাসসহ শরণাগতি স্বীকার করে আত্মনিবেদন করলেন মনে মনে শ্রীকৃষ্ণের চরণে, তখন ভগবান অনন্ত বস্ত্রের যোগান দিয়ে তাঁর সম্মান রক্ষা করলেন। পূর্ণরূপে ভগবানের চরণকমলে আত্মনিবেদিত হতে পারলে যে ভগবানই রক্ষা কর্তা হয়ে অক্ষয় কৃপা করেন। এ লীলা তারই নিদর্শন।
- কথিত আছে যে অক্ষয় তৃতীয়ার দিনই সূর্যদেব পাণ্ডবদের বনবাসের সময় অক্ষয় পাত্র দান করেন। একথালা অন্ন দ্রৌপদীর আহার গ্রহণের আগে পর্যন্ত যতজন উপস্থিত থাকতো তাদেরকে খাওয়ানো যেত।
- দীর্ঘকাল তপস্যার পর মহাদেবকে প্রসন্ন করে যক্ষরাজ কুবের স্বর্গের সমস্ত ধনসম্পত্তির অধিকারী দেবতা হন এই তিথিতেই।
- এই তিথিতেই প্রতিবছর পুরীতে শ্রীজগন্নাথদেবের রথের নির্মাণকার্যের শুভ সূচনা হয়। ভক্তবৎসল জগন্নাথদেব ভক্ত দর্শনের জন্য রথযাত্রা করেন, আর ভক্তদের প্রতিও তাঁর অক্ষয় কৃপা এই যে, স্বয়ং ভগবান মন্দির থেকে পথে আসেন তাঁদের দর্শনসুখ দিতে।
- প্রবাদ আছে-এই তিথিতেই ভিক্ষা করতে গিয়ে আদি শঙ্করাচার্য এক নিঃসম্বল দম্পতির থেকে, তাদের কুঠিরের একমাত্র খাদ্যবস্তু একটি-টেপারি ফল প্রাপ্ত হলেন। নিদারুণ দৈন্যাবস্থা সত্ত্বেও ক্ষুধায় কাতর দম্পতি ভিক্ষাদানে এমন আগ্রহ দেখে শঙ্করাচার্য ‘কলকাধার’ নামক বিখ্যাত শ্লোকটি রচনা করেন, যা তার এক অক্ষয় কীর্তি।
- ‘গোয়া’ ও ‘কেরল’ এই তিথিতেই পরশুরাম ক্ষেত্র নামে চিহ্নিত হয়।
কৃষিপ্রধান ভারতে অক্ষয় তৃতীয়ার দিনটিতে অনেক জায়গায় ধরিত্রীদেবীর পুজো করা হয়। এ ছাড়াও দেশ জুড়ে পালিত হয় নানা উৎসব ও শুভ কাজ।
এই তিথিতে যা শুভকর্ম করা হয়, তার ফল অক্ষয় পূণ্যদায়িনী। যা জ্ঞান আহরণ করা হয়, এই তিথিতে-তাও অক্ষয় প্রভাব ফেলে বুদ্ধিতে, চিত্তে। দানের ফলও অক্ষয় হয়। স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, তাহলে এই তিথিতে যদি ইচ্ছা-অনিচ্ছায় বা অজ্ঞাতে যদি কোন পাপকর্ম করে ফেলি, তবে সেটাও অক্ষয় পাপ হয়ে কর্মফলের খাতায় লেখা থাকে। তাই সর্তক থাকাটাই শ্রেয়। অজান্তেও কোন পাপ বা বৈষ্ণব অপরাধ, সেবাপরাধ নামাপরাধ, না করে ফেলি বা কোন কুভাবনা না ভাবি-সে বিষয়ে সজাগ থাকাটাই সমীচীন। তাই এই মহাত্ম্যপূর্ণ তিথিকে ভাগবত শ্রবণ, শ্রীগুরুসেবা, সাধুসঙ্গ, মালা জপ-বেশী করে মনকে গৌর-গোবিন্দের শ্রীচরণেসেবায় ব্যস্ত রাখব।
‘যার থাকবে গৌরপ্রেমে রতি,
কলি তার করবে কোন্ ক্ষতি?
অক্ষয় তৃতীয়ায় ক্ষয়হীন কৃপা এভাবেই একমাত্র লব্ধ করা সম্ভব।